ঢাকা শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্বরূপ
ফৌজিয়া রিনি
প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকা। ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রতিদিন ১৪১৮ জন মানুষ বাড়ছে। বছরে যুক্ত হচ্ছে গড়ে পাঁচ লাখ সাড়ে ১৭ হাজার মানুষ৷ এত বেশি সংখ্যক মানুষ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা। কিভাবে চলছে ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা?
সাধারণত কোন এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝায় সে এলাকার সকল বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন ও অপসারণ। যে জায়গায় বর্জ্য অপসারণের লক্ষ্যে স্তূপাকারে জমা করা হয় তাকে বলা হয় ল্যান্ডফিল সাইট (Landfill Site)। একটি আদর্শ ল্যান্ডফিল সাইট নির্মাণে বেশ কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। ১৯৯১ সালে Environment Protection Agency (EPA), ল্যান্ডফিল সাইটের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নীতিমালা প্রদান করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুলো হচ্ছেঃ একটি ল্যান্ডফিল সাইটের ৩০ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোন জলাশয় থাকা যাবে না, ১৬০ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোন খাবার পানির নলকূপ থাকা যাবে না এবং ৬৫ মিটার দূরত্বে কোন ঘরবাড়ি, স্কুল ও পার্ক থাকা যাবে না। যদিও ঢাকা শহরের দুটি ল্যান্ডফিল সাইট (মাতুয়াইল ও আমিনবাজার) এর একটিও এই নিয়ম মেনে নির্মাণ করা হয় নি।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য দুটি প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে এরিয়া মেথড (Area Method) ও ট্রেঞ্চ মেথড (Trench Method)। এরিয়া মেথড এ মাটির উপরে আবর্জনার স্তূপ জমা করে রাখা হয়। প্রতিদিন জমা করার পর এর উপর মাটির আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। অন্যদিকে, ট্রেঞ্চ পদ্ধতিতে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে বর্জ্য জমা করে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ঢাকা শহরের ল্যান্ডফিল সাইট গুলোতে এরিয়া মেথড প্রয়োগ করা হলেও দিনশেষে এটাকে মাটি দিয়ে ঢাকার বদলে উন্মুক্তভাবে ফেলে রাখা হয়।
বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডাম্পিং হয় ৩ হাজার ৮শ মেট্রিক টন। অপর এক বেসরকারি জরিপ অনুযায়ী, প্রতিদিন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হয় ৫ হাজার ৯শ ৫০ মেট্রিক টন। এছাড়া মেডিকেলসহ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার ৫০ এবং রাস্তাঘাট থেকে ৪শ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। প্রতিদিন নগরীতে মাথাপিছু উৎপাদিত হয় ৫শ ৬০ গ্রাম বর্জ্য। উৎপাদিত বর্জ্যের মধ্যে আছে প্লাস্টিক, কাগজ, কাচ, ধাতু এবং জৈব বর্জ্য। ঢাকা শহরের বিপুল পরিমাণ জনগণের বিপরীতে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী আছে ৭ হাজার ৫শ জন। প্রতি ১ হাজার স্থায়ী নাগরিকের জন্য একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। এই কর্মীরা শহরের বিভিন্ন জায়গায় সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে বর্জ্য এনে ফেলছেন। অধিকাংশই রাস্তার ওপর, খোলামেলা, যেনতেনভাবে। পথচারী আর আশপাশের মানুষের জন্য যা দুঃসহ দুর্ভোগের কারণ। কিছু কাভার্ডভ্যান থাকলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে খোলা ট্রাকে করে এই বর্জ্য নেয়া হয় আমিনবাজার ও মাতুয়াইল ল্যান্ড ফিল্ডে। যেখানেও নেই নিরাপদ ব্যবস্থাপনা।
অপরিকল্পিতভাবে ল্যান্ডফিল সাইটে বর্জ্য স্তূপীকরণের কারণে সৃষ্টি হয় নানারকম সমস্যা। ল্যান্ডফিল সাইটের আশেপাশে দেখা যায় পোকামাকড়ের উপদ্রব, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর বিস্তার ও দুর্গন্ধ। এছাড়া অব্যবস্থাপনা ফলে বায়ু দূষণ ও পানি দূষণ ব্যাপকতা লাভ করছে। এছাড়া বিভিন্ন উৎস থেকে আসা বর্জ্য পদার্থ কোন রকম বাছাই ছাড়াই একসাথে ডাম্প করা হচ্ছে। নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে এখনো আলাদা করা হয়নি মেডিক্যাল বর্জ্যকে। স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মেডিক্যাল বর্জ্য আলাদা না করে এখনো ফেলা হয় ডাস্টবিন, রাস্তাঘাটসহ যত্রতত্র। নিক্ষিপ্ত বর্জ্যের তালিকায় রয়েছে ব্যবহৃত সুচ, সিরিঞ্জ, রক্ত ও পুঁজযুক্ত তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, মানব-প্রত্যঙ্গ, ওষুধের শিশি, ব্যবহৃত স্যালাইন, রক্তের ব্যাগ এবং রাসায়নিক দ্রব্যসহ সব ধরনের চিকিৎসাজাত ময়লা-আবর্জনা। এসব বর্জ্য যথাযথভাবে প্রক্রিয়াকরণ না করায় বিভিন্ন রোগব্যাধি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
এ সমস্যা সবচেয়ে সহজ সমাধান হচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন রঙের কনটেইনারে ভিন্ন ধরনের বর্জ্য ফেলা। ঢাকা মহানগরীতে প্রায় তিন বছর আগে প্রতি ঘরে ঘরে লাল, সবুজ ও হলুদ কন্টেইনার বিনামূল্যে সরবরাহ করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এসবের ব্যবহার হচ্ছে না। গৃহস্থালী বর্জ্য, মেটাল, প্লাস্টিক ও ঝুকিপূর্ণ বর্জ্য আলাদা ভাবে ফেললে এগুলো থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা কমে যাবে। গৃহস্থালী পচনশীল জৈব বর্জ্য থেকে কম্পোস্টিং এর মাধ্যমে খুব সহজেই সার তৈরি করা সম্ভব। এছাড়া কাগজ, প্লাস্টিক ও মেটালকে রিসাইকেল করা সম্ভব।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনসচেতনতা, জনগণের অংশগ্রহণ। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এই বর্জ্যকে বদলে দিতে পারে সম্পদে। প্রয়োজন সকলের সদিচ্ছা আর সচেতনতা।
লেখকঃ সভাপতি, নেচার কনজারভেশন ইনিশিয়েটিভ