পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত "কে-টু" জয়ের পেছনের তিক্ত ইতিহাস!- পর্ব ২
দেবাশিষ বল
কে-টু অভিযানের পূর্বকথা ————————————-
১৯৫৪ সাল।
সময়টা ছিল অদ্ভুত। দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ আর ক্ষত থেকে সবে সেরে উঠেছে। পঞ্চাশের দশকে অভিযানের স্বর্ণযুগের সেই সময়টায় প্রতিটি অভিযানের সাথেই জাতীয় গৌরব আর অর্জন লতায়পাতায় জড়িয়ে গিয়েছিলো। সবগুলো বড় শক্তি এবার যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পর্বতারোহণের মঞ্চ, হিমালয়ে নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ইঁদুর দৌড়ে নেমে পড়েছে। এর আগে হিমালয়ে কখনই উল্লেখযোগ্য কোন সাফল্য না পাওয়া ফ্রান্স ১৯৫০ সালের অন্নপূর্ণা জয় দিয়ে তাদের অপূর্ণতার ক্ষতে কিছুটা প্রলাপ লাগিয়েছে। ৮০০০ মিটার উঁচু অন্নপূর্ণার মহাকাব্যিক জয় যুদ্ধে জার্মানদের হাতে নাকাল হওয়া পুরো ফ্রান্স জাতিটাকেই গৌরবের অনন্য এক অনুভূতি উপহার দেয়। এমনকি এর কিছু বছর পর ১৯৫৬ সালে পুচকে জাপানও নেপালের ২৬,৭৮১ ফুট উচ্চতার মানাসলু জয়ের মধ্যে দিয়ে এই দৌঁড়ে সামিল হয়ে পড়ে।
যাইহোক, কে-টু অভিযানে ফিরে আসি। যুদ্ধপরবর্তী ঐ সময়টায় যেকোনো অভিযানে দলনেতা হিসেবে স্বয়ংক্রিয় পছন্দ ছিল সামরিক পটভূমির কোন কর্তা গোছের ব্যক্তি। কর্তাব্যক্তিদের মনে হতো এই মাপের যেকোনো অভিযানে সফল হওয়ার জন্য যে শৃঙ্খলা ও নির্দেশনা দরকার সেটার জন্য একজন সামরিক ব্যক্তিই উপযুক্ত পছন্দ। এই চিন্তাভাবনার ফসল হিসেবেই আমরা অন্নপূর্ণায় মরিস হেরজগ, এভারেস্টে স্যার জন হান্ট এবং নাঙ্গা পর্বতে কার্ল মারিয়া হেরলিগকোফার-কে দলনেতা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাই।
যুদ্ধে হেরে যাওয়া বিধ্বস্ত ইতালির জন্য হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার বড় এক উপলক্ষ হিসেবে আসে কে-টু এর ১৯৫৩ সালের অভিযান। এমন এক মহাগুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় দলনেতা হিসেবে তাই বেছে নেয়া হয় ৫৭ বছর বয়সী অধ্যাপক “আরদিতো দেসিও”-কে। তিনিই পুরো এক্সপিডিশনটা পরিচালনা করবেন নিজ হাতে।
যাইহোক, মজার ব্যাপার হল প্রাথমিক সামিট টিমের নিশ্চিত সদস্য হওয়া নিয়ে একজনের ব্যাপারে কখনই কারো মনে কোন প্রশ্ন ছিলো না। তিনি আচিলি কম্পেগননি। সবাই জানতো যে আচিলি অধ্যাপক দেসিও-র বিশেষ অনুগ্রহভাজন ও পছন্দের পাত্র। এক আচিলি ছাড়া দলের বাকি সবার সাথে দেসিও-র ব্যবহার ছিল প্রচণ্ড রুক্ষ ও কঠোর। এমন অভিযানের জন্য হয়তো তেমনটাই দরকার ছিলো!
বেস ক্যাম্পে প্রতিদিনের অর্ডার গুলো উনি সবাইকে টাইপ করে দিতেন। একদিন সবার হাতে এলো তাঁর একটা নির্দেশনা যেটায় লেখা – “যে আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে না তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। তাকে শাস্তি দেয়া হবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র “প্রেস” (পত্রিকা) দিয়ে।” তার মিলিটারি মেজাজের “সামান্য” একটি নজির এটি! (পরবর্তীতে ওয়াল্টার বোনাত্তির সাথে ঠিক তাই করা হয়েছিলো!)
এবার মূল কাহিনীতে ফিরে আসি।
২৬,৫৭৫ ফুট উচ্চতায় আটকা পরা বোনাত্তি আর তার সঙ্গী মেহেদির জীবন পাল্টে যেতে যাচ্ছে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে শীতের তীব্রতাও নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় সকাল পর্যন্ত নিজেদের টিকে থাকা নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছে বোনাত্তির মনে। ওদিকে মেহেদির সেসব চিন্তা করার মতো অবস্থাও নেই। ও এতো কাহিল হয়ে পড়েছে যে কিছুক্ষণ আগে বোনাত্তি একরকম জোর করেই ওর পায়ের ক্রেম্পন খুলে দিয়েছে, নইলে ওর ফ্রস্ট বাইটের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যেত। পুরো রাত বোনাত্তি কাটালো নিজের পাঁচটা আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। সন্দেহ হচ্ছিলো ওগুলো আছে কি-না! মাঝে মাঝে মাথায় হরেকরকম চিন্তা তৈরি করে দেখছিল এখনো ও সুস্থভাবে চিন্তা করতে পারছে কি-না। সাথে একটু পরপর চলছিলো আইসএক্স দিয়ে নিজের অসাড় পা দুটোয় ক্লান্তিকর বাড়ি মারা।
ভোররাতের দিকে তুষারপাত এতো বেড়ে গেলো যে বেশ কবার ওদের আস্তানা পুরোপুরি ঢেকে যায়।
সকালের দিকে শরীরটা একটু নড়াচড়া করার সাথে সাথে বোনাত্তির মনে হল ও যেন একটুকরা বরফ, এমনি জমে গেছে ও। আলোর প্রথম রেখা দেখা যেতেই মেহেদি একরকম দৌড়ে ৮ নং ক্যাম্পের দিকে নামা শুরু করে। ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে গেলেও গতরাতের মতো মেহেদিকে আবার আটকানোর অবস্থা বোনাত্তির নেই। চোখের সামনে দিয়ে মেহেদিকে এভাবে নেমে যেতে দেখে নিঃশ্বাস নিতে একরকম ভুলেই গেছে ও। কিন্তু মেহেদি একটু সমতল জায়গায় পৌঁছানো মাত্র বোনাত্তি বুঝতে পারলো লোকটা এখন “ওকে”। ৮ নম্বর ক্যাম্পের নিরাপদ আশ্রয় আর বেশি দূরে নয়……
২৬০০০ ফুট উচ্চতায় বিভীষিকাময় একটা রাত কাটিয়ে বোনাত্তি ও মেহেদি অবশেষে ৮ নং ক্যাম্পে ফিরে আসতে সক্ষম হল। ওদের দেখে ক্যাম্পের লোকজন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। এই দুজন বেঁচে আছে! কিভাবে সম্ভব ? তাড়াতাড়ি ওদের দুজনকে তাবুতে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো লোকজন। একহাজারটা প্রশ্ন ওদের দিকে ছুটে আসছে দেখে প্রমাদ গুনলো ক্লান্ত বোনাত্তি। কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো অবস্থা ওদের ছিলোনা। হয়তো ওদের মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেই ক্যাম্পের লোকজন ওদের শুশ্রুষাতে নেমে পড়লো। অলৌকিকভাবে বোনাত্তি পুরোপুরি অক্ষত ও সুস্থ ছিল। কিন্তু মেহদি অতোটা ভাগ্যবান নয়। ওর দু’পায়ের পাতা আর সবগুলো আঙ্গুল খুব খারাপভাবে ফ্রস্তবাইটের শিকার হয়েছে। তখনো বোঝা না গেলেও পরে ওর দু’পায়ের সবগুলো আঙ্গুল কেটে ফেলে দিতে হয়েছিলো। সেই ইটালিয়ান এক্সপিডিশনের সত্যিকারের আত্মত্যাগ করেছিলো মেহেদি। তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ হাঞ্জা ক্লাইম্বার মেহেদির ক্লাইম্বিং ক্যারিয়ারের সেখানেই ইতি ঘটে। অমন দুর্দান্ত এক পর্বতারোহী এরপর আর কখনো পর্বতে চড়তে পারেনি।
ওদিকে সামিটের নেশায় বুঁদ কম্পেগননি আর লাচেডেলি এসবের প্রায় কিছুই জানেনা। ভোর হতেই বোনাত্তি আর মেহেদির রেখে যাওয়া অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো নিয়ে তারা সামিটের উদ্দেশে রওনা দেয়।
সেদিন ছিল ৩১শে জুলাই। বিকেলের খানিকটা পরে তাঁরা প্রায় একই সাথে কে-টু এর চূড়ায় পৌঁছায়।
ইটালিয়ান টিমের কে-২ জয়ের এক বছর পর La Conquista del K2 (Victory Over K2) নামে প্রকাশিত ওই এক্সপিডিশনের অফিসিয়াল রিপোর্টে দলনেতা দেসিও কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্প উপস্থাপন করেন। কম্পেগননি ও লাচেডেলির বয়ান দিয়ে তিনি বলেন যে এই দুজন নাকি কল্পনাও করেনি যে বোনাত্তি ও মেহদি সেই রাতে নেমে না গিয়ে বিভোয়াক করে রাতটা ওখানেই কাটিয়ে দিয়েছিলো। তাদের ভাষায় “পরদিন সকালে আমরা যখন বোনাত্তি ও মেহদিকে ৮ নং ক্যাম্পের দিকে দ্রুত নেমে যেতে দেখলাম নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আর কিভাবেই বা করবো ?! আমাদের সুদূর কল্পনাতেও ছিল না যে দুজন মানুষ ২৬০০০ ফিট উচ্চতায় এমন ভয়ঙ্কর আবহাওয়ায় কোন আশ্রয় ছাড়া উন্মুক্ত অবস্থায় পুরো রাত টিকে থাকতে পারে!
কম্পেগননি আর লাচেডেলি দুজনেই দাবী করে যে সেদিন রাতে সাহায্যের জন্য বোনাত্তি ও মেহদির বারংবার চিৎকার তাদের কানেই পৌঁছেনি। অক্সিজেন রেখে দিয়ে বোনাত্তি ও মেহদিকে নিচে চলে যেতে বলার পর নাকি তাদের মধ্যে আর যোগাযোগ হয়নি এবং এর জন্য তারা বাতাসের তীব্র গর্জনকে দায়ী করে। বাতাসের তীব্রতায় নাকি বাইরের কিছুই শোনা যাচ্ছিলো না!
যাইহোক, এখানেই ওই গল্পের শেষ নয় বরং মূলত এখনি ঘটনার ঘনঘটার শুরু…
(চলবে…)
লেখাটির ১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
Good write up.