আবেগপ্রবণ যন্ত্র !!
উম্মে ছালমা
আবেগ বা মন যাই বলুন না কেন,সে কিন্তু বড় কঠিন জিনিস রে ভাই। না আপনি কারো আবেগ বুঝতে পারেন, না আপনার আবেগ কেউ বুঝতে পারে। প্রেমিক বা প্রেমিকার মন বুঝতে না পারার কারণে ঘটে অর্ধবছরের প্রেমের সমাপ্তি, বন্ধুর দুঃখের আবেগে ফাইজলামি মূলক মন্তবের কারনে শুরু হয় ঝগড়া, আর বাবা মার মন খারাপের মুহূর্তে ঘুরতে যাওয়ার টাকা চেয়ে বেদম জারি, আরও কত কি! এইসব কিন্তু অনেকের জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনা। যদি আগে থেকেই অন্যদের মনের অবস্থা জানা থাকতো তাহলে হয়ত এই সব ঝামেলা থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। আর নিজের মনের কথা আর নাই বা বললেন। বিয়ের বয়স হয়ে যায় কিন্ত মনে মতো পাত্র পাত্রী পর্যন্ত পাওয়া যায় না। প্রেমের কথা নাই বা বলা হলো। হায়! এই দুনিয়াতে কি এমন কেউ নেই যে কিনা ভেতরের এই আবেগটাকে বুঝতে পারবে??
ঠিক এই রকম যারা আবেগ নামক সমস্যায় আবেগীভাবে জর্জরিত হয়ে নিজের জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছেন না তাদের জন্য সুখবর। না না ভয় পাবেন না, এখানে কোন বিবাহ.com এর প্রচারনা করা হচ্ছে না। এখানে বিজ্ঞান সম্মত সুখবর দেয়া হচ্ছে। সুখবরটা হল যাদের আবেগ কেউ বুঝতে পারে না, বা যারা অন্যদের আবেগ বুঝতে পারে না তাদের সাহায্য করবে নতুন একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রাম আপনার আবেগ বা মন যাই বলুন না কেন তা বুঝতে পারবে এবং আপনার মন মতো আচরণও করবে।
এখন পর্যন্ত আবেগ বা emotion এর ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে স্মার্ট কিন্তু আর কেউই নেই। তা কম্পিউটার বা যত আধুনিক যন্ত্রই হোক না কেন, জটিল জটিল mathematical task তা মানুষের চেয়ে যত দ্রুতই করতে পারুক না কেন, আবেগের প্রশ্নে সব যন্ত্রই বেকুব। কিন্তু নতুন একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম হয়ত আমাদের এই ধারনা বদলে দিতে পাবে। এই আবেগপ্রবণ যন্ত্র মানুষের আবেগ সনাক্ত করতে সক্ষম তাও আবার সামান্য টাইপিং এর মাধ্যমেই। কি! তাক লাগিয়ে দেবার মতো খবর না!!
আর এই গবেষণাটি করেছেন আমাদের দেশের Islamic University of Technology এর কয়েকজন গবেষক। এই নতুন গবেষণার জন্য গবেষকরা সাহায্য নিয়েছিলেন কয়েকজন মানুষের যাদের একটি sample text টাইপ করতে বলা হয়েছিল। তারপর তাদের keystrokes আর বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল, এটা দেখতে যে তারা আবেগের ৭ টি অবস্থা (emotional states) যেমন রাগ, আনন্দ, দুঃখ, ভয়, লজ্জা, অস্বস্তি বা অপরাধবোধ বিশ্লেষণ করতে পারেন কিনা।
আর অভাবনীয়ভাবে program টি শতকরা ৮০ ভাগ সঠিকভাবে আনন্দ (৮৭% নির্ভুলভাবে) এবং রাগ (৮১% নির্ভুলভাবে) সনাক্ত করতে পেরেছে। এ সম্পর্কে IUT এর গবেষকরা বলেন “যদি আমরা এমন কোন system তৈরি করতে পারি যা মানুষের সাথে interact করার জন্য যথেষ্ট বুদ্ধিমান অর্থাৎ যদি তা ব্যবহারকারীর আবেগ সনাক্ত করতে সক্ষম হয় আর সে অনুসারে যন্ত্রটির ব্যবহার নিজে নিজে পরিবর্তন করে তাহলে যে কোন যন্ত্র ব্যবহার করা আরও বেশি সহজ এবং সাচ্ছন্দময় হয়ে যাবে।
আবেগ সনাক্ত করার জন্য typing এর সময় ব্যবহারকারীর keystrokes নিয়ে গবেষণা করেছেন কারণ এটি অত্যন্ত সহজ এবং খরচবিহীন একটি মাধ্যম যেটা দিয়ে কম্পিউটার আর ব্যবহারকারীর মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক বা interact তৈরি হয়।
গবেষকরা বলেন emotion-detecting system অনলাইন এ শিক্ষা দেবার মত অ্যাপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।একটি আবেগ সনাক্ত করার মত (বা আবেগপ্রবন যাই বলুন না) বুদ্ধিমান অনলাইন সিস্টেম একটি ছাত্রের মানসিক অবস্থা মানিয়ে তার রূপ, শিক্ষাদানের ধরন অথবা বক্তৃতার বিষয়বস্তু পরিবর্তন করতে পারবে।
এখন একটু জেনে নেই আবেগ কি? আবেগ হল শারীরিক বা আচরণগত প্রতিক্রিয়া যা মানুষের চাহিদা, লক্ষ্য বা নিজস্ব চিন্তা থেকে হয়ে থাকে। তাই গবেষণার প্রথম ভাগে, ১৫ থেকে ৪০ বয়সের ২৫ জন ব্যক্তিদের লুইস ক্যারল এর বিখ্যাত উপন্যাস “ওয়ান্ডারল্যান্ড মধ্যে এলিস এর এডভেন্ঞার ট্যুরিজম” থেকে দুটি অনুচ্ছেদ retyped করেন এবং অবচেতন মনে তারা আনন্দ, ভয়, রাগ নিরপেক্ষ বা ক্লান্ত বোধ, বিষণ্ণতা, বিতৃষ্ণা, লজ্জা, অপরাধবোধ টাইপ করার সময় একেক আবেগ অনুভব করছিলেন।
গবেষণার দ্বিতীয় অংশ গবেষকরা একটি সফটওয়্যারটি ব্যবহার করেন যেটাতে ওইসব ব্যবহারকারীদের টেক্সট নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং যেখানে প্রতি ৩০ মিনিট পরপর ব্যবহারকারীদের মানসিক অবস্থায় প্রবেশ করতে অনুরোধ জানানো হয় নিম্নলিখিত সম্ভাবনার থেকে যে কোন একটি নির্বাচন করে : আনন্দ, ভয়, রাগ, দুঃখ, বিতৃষ্ণা, লজ্জা, অপরাধবোধ বা কোনটিই নয়। পরীক্ষা এই অংশে, ব্যবহারকারীরা নির্ধারিত কোন টেক্সট টাইপ করেছিলেন না, বরং তাদের নিয়মিত কম্পিউটার ব্যবহারের সময় তারা যেসব টেক্সট টাইপ করছিলেন তা সংগ্রহ করা হয়। গবেষকরা এসময় একটি বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করেন যা ব্যবহারকারীদের কম্পিউটার চলাকালীন সময় background চলছিল ও ব্যবহারকারীদের key press and release times প্রেস রেকর্ড করছিল। গবেষকরা তারপর সংগৃহীত তথ্য থেকে ১৯ ধরনের কীস্ট্রোক সনাক্ত করতে সক্ষম হন। এই পদ্ধতিটি সাতটি মানসিক অবস্থার জন্য অসাধারণ ফলাফল দেখিয়েছন এবং অন্যান্য অবস্থার জন্যও ভালো সুযোগ রয়েছে।
Myounghoon Jeon, মিশিগান টেকনোলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে applied cognitive science এর সহকারী অধ্যাপক বলেন “হয়তো এই আবেগ সনাক্তকারী সিস্টেমটি একটি যুগান্তকারীর মত দেখাচ্ছে না এবং এতে এখনও কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা আছে যেমন খুব রাগান্নিত বা দুঃখের সময় হয়তো কেউ কিছু লিখতে চাইবে না কিন্তু এই পদ্ধতিটি সফল করার প্রচেষ্টা ন্যায্য, ইতিবাচক এবং সম্ভাবনাময়। তাছাড়া এই সিস্টেমটি অনলাইন কাউন্সেলিং সেশন এর জন্য একটি মূল্যবান হাতিয়ার হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কিছু কিছু সমাজ আছে যেখানে জনপ্রিয় অনলাইন কাউন্সেলিং বিশেষ জনপ্রিয়, সেখানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা অনলাইন কাউন্সেলিং এর সাহায্যেই রোগীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা অনুমান করতে পারবেন।”
দিন দিন পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানবসৃষ্ট আবেগের ঘনমাত্রা। এই অতিরিক্ত আবেগের ঘনমাত্রা যেন পরবর্তীতে পরিবেশে কোন বিরূপ মাত্রা না ফেলতে পারে সেই ক্ষেত্রে এই গবেষণাটি হয়তো কোন গুরুত্তপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। তাই যারা এত আবেগের মাঝে আবেগী হয়ে এখনও মনের মত কাউকে পাননি তারা আর একটু ধৈর্ঝ্য ধরুন। কিছুদিন পর মনের মতো মানুষ না পেলেও নিশ্চিতভাবে মনের মতো যন্ত্র পেয়ে যাবেন। যা আপনার পরিবর্তনশীল আবেগের সাথে সাথে মনের মতো পরিবর্তনশীল রূপ ধারন করবে।
সূত্র : লাইভসাইন্স.কম