অস্বাভাবিক বজ্রপাত – একি প্রকৃতির আর্তনাদ; নাকি হুংকার!!!!!!
হুমায়রা হেদায়েত স্বর্ণা
বলতে পারেন আমরা কখন চিৎকার করি অথবা কখন আর্তনাদে ফেটে পড়ি????
আপনারা বেশিরভাগই বলবেন যে, কারো প্রতি মনের ঝালটুকু মিটিয়ে নেবার জন্য কিংবা মনের গভীরে ধীরে ধীরে জমে থাকা কষ্টগুলো উগলে ফেলার জন্য। প্রকৃতিও কিন্তু এর ব্যতিক্রম নয়!!! তার প্রতি করা ক্রমাগত অবিচারগুলোর প্রতিশোধ নেবার জন্যই সে আজ অগ্নিমূর্তি ধারন করেছে। সাথে আকাশ সাক্ষী হয়ে বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে জানিয়ে দিচ্ছে যে, সে আর এই অবিচার সহ্য করবে না।
ভাবছেন আকাশ কীভাবে চিৎকার করে???!!! হ্যাঁ, করে তো!! গগনবিদারী বজ্রপাতই তো এর চিৎকার আর এর আলোর ঝলকানি যেন উদ্যত হাতে ধেয়ে আসা রাগান্বিত ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি!! কিন্তু, এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই ঘটে চলেছে। ঝড়-বৃষ্টির দিনে বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক ঘটনা স্বাভাবিক হলেও সম্প্রতি এর পরিমাণ বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। আর সেই সঙ্গে বাড়ছে মানুষ মৃত্যুর সংখ্যা। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এ মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বিশেষজ্ঞসহ দেশের সাধারণ মানুষ।
ছোটবেলায় পড়েছি, মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বজ্রপাত ঘটে। কিন্তু এটাইতো আর শেষ কথা নয়। উত্তপ্ত বায়ু যখন দ্রুত গতিতে ঠান্ডা হয়, তখন বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়। এই বজ্রমেঘের ভেতরে, বাতাসের দ্রুত গতির আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর ফলে বাতাসের জলীয়বাষ্প একই সময়ে বৃষ্টিকণা, শিশিরবিন্দু ও তুষারকণায় পরিণত হয়। বৃষ্টিকণা আর তুষারকণার পারস্পারিক সংঘর্ষের ফলে তুষারের ইলেকট্রন চার্জ ধাক্কা খায়। এতে করে স্থির বৈদ্যুতিক চার্জের সৃষ্টি হয়। এই চার্জ সঞ্চিত হয়ে তীব্র শব্দের বজ্রপাত সৃষ্টি করে। যখন বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ উচ্চ তাপমাত্রা সৃষ্টি করে, তখনই তীব্র শব্দের সৃষ্টি হয়। বাতাসের মধ্য দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত বজ্র বিদ্যুৎ প্রায় ৩০ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উৎপন্ন করে। ফলে বায়ু দ্রুত সম্প্রসারণ হয় এবং তীব্র শব্দের সৃষ্টি হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আকাশে যে মেঘ তৈরি হয় তার ২৫ থেকে ৭৫ হাজার ফুটের মধ্যে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে বেশি। এ এলাকায় তড়িৎ প্রবাহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ ঘটে। এখানে খাড়াভাবে যে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয় তার তাপমাত্রা ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট। বজ্রপাতের গতিও প্রতি সেকেন্ডে ৬০ হাজার মিটার। যা প্রচণ্ড বেগে নিচে বা উপরের দিকে চলে যায়। ফলে এ পরিমাণ তাপসহ বজ্রপাত মানুষের দেহের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হওয়াই স্বাভাবিক। সাধারণত আকাশের ৪ মাইল সীমার মধ্যে মেঘের সৃষ্টি হয়। এ সীমার উপরে পানি, বাতাস থাকলেও তা ঠাণ্ডা এবং হাল্কা পরিমাণে থাকে। আকাশের এ সীমার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মেঘের সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে কালো বা ঘন কালো মেঘ থেকে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে।
শুধু কালো মেঘই নয়, জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন ও নগরায়ন বজ্রপাত বৃদ্ধির পরোক্ষ কারণ। কালো মেঘ সৃষ্ঠির পেছনে বাতাসে নাইট্রোজেন ও সালফার গোত্রের গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞগণ। জলবায়ু পরিবর্তনের্ কারণেই এই গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির টাওয়ারও বজ্রপাতের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বজ্রপাতের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের সাবেক প্রধান ও বর্তমান সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মো: আবদুল মতিন বলেন, ‘প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কার্বন, নাইট্রোজেন ও সালফার গ্যাসের পরিমাণ যত বাড়বে বজ্রপাতের পরিমাণও ততটা বাড়তে থাকবে। আর ভূমিতে বজ্রপাত ঘটার পেছনে অপরিকল্পিত মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ারও দায়ী।’
তিনি আরো বলেন, ‘মোবাইল টাওয়ারগুলো উচ্চতার কারণে বজ্রপাতের প্রথম শিকার হওয়ার কথা। কিন্তু আর্থ কানেকশন (ভূ-সংযোগ) ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এবং বজ্রপাতের বিদ্যুতের প্রবাহকে অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বা প্রযুক্তি এ সব টাওয়ারে রয়েছে। একই সঙ্গে এ সব টাওয়ার অত্যধিক ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড (তড়িৎ চৌম্বকক্ষেত্র) সৃষ্টি করায় বজ্রপাতে তৈরি হওয়া ইলেকট্রনও টাওয়ারগুলোর দিকে আকৃষ্ট হয়। আর উচ্চপ্রযুক্তির কারণে বজ্রপাতের বিদ্যুৎ এ সব টাওয়ার কিছুটা ভূ-সংযোগের মাধ্যমে কমিয়ে ফেলে বাকিটা অন্যদিকে সরিয়ে দেয়। ফলে যত্রতত্র বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে।’
আবদুল মতিন আরও বলেন, ‘একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। বাসাবাড়িতে আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি তার ক্ষমতা মাত্র ২২০ ভোল্ট। শিল্পকারখানায় ১২০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। আর জাতীয় গ্রিডে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১১০ ভোল্ট বিদ্যুতই যথেষ্ট।’
মানুষ যেমন হিংস্র হচ্ছে প্রকৃতির প্রতি , প্রকৃতিও তার হিংস্র রূপ মানুষকে দেখাতে চাইছে। অস্বাভাবিক ভাবে বজ্রপাত বাড়িয়ে দিয়ে প্রকৃতি হয়তো সেই হিংস্র মানুষের প্রতি প্রতিশোধ নিতে চাইছে। অথবা, গগনবিদারী আর্তনাদের মাধ্যমে মানুষকে তার প্রকৃতির প্রতি নিষ্ঠুর খেলা থামাতে বলছে কিংবা হুংকারের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে চাচ্ছে যে, প্রয়োজনে প্রকৃতি এর চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপ নিতে জানে।