
পর্যটন শিল্প ও বাংলাদেশ
সন্তোষ কুমার দেব
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে এ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প উন্নয়নের সম্ভাবনা অপরিসীম। নতুন করে কৌশল ঠিক করে সম্ভাবনার সবটুকুকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পর্যটনে মডেল হতে পারে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও বিদ্যমান পর্যটক আকর্ষণে যে বৈচিত্র্য তা সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। পৃথিবীতে পর্যটন শিল্প আজ বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পর্যটন শিল্প বিকাশের ওপর বাংলাদেশের অনেকখানি সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করছে। দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটলে কর্মসংস্থান ঘটবে ও বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সফল হবে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের প্রাচীন যুগের ইতিহাস ও শিল্প, সাহিত্য, কালচার ও প্রথার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ঐতিহাসিক স্থান দেখার জন্যও পর্যটকরা নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে দূর-দূরান্তে ছুটে চলে প্রতিনিয়ত। পর্যটন হলো একটি বহুমাত্রিক শ্রমঘন শিল্প, এ শিল্পের বহুমাত্রিকতার কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্ভাবনা তৈরি হয়। ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি অনুদান ও সংশিল্গষ্ট বিভাগের সঙ্গে যথাযথ সমন্বয় সাধন করার পাশাপাশি উন্নত অবকাঠামো, সঠিক পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থা দরকার পর্যটনের জন্য। পর্যটন শিল্পের উপাদান ও ক্ষেত্রগুলো দেশ-বিদেশে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের অধিকতর বিকাশ ঘটানো। ২০১৩ সালে পর্যটন খাতে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে এ খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও ৪ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। সে হিসাবে ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর, যেমন-পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যে কোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি।
বর্তমানে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থানগুলো দূষণের শিকার। দেশে প্রয়োজনীয় পর্যটন বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, কুয়াকাটা, সুন্দরবনের সমুদ্রসৈকত সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থা না থাকায় জাহাজ ভ্রমণকালে পর্যটকরা তাদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি সমুদ্রে ফেলে পরিবেশ দূষণ করছে। প্রবালের ফাঁকে এসব দ্রব্য জমে এক ধরনের নোংরা পরিবেশ সৃষ্টি করছে। কোরালের ওপর বালুর আস্তর জমে যাচ্ছে। অনেকে কোরাল কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এতে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। একই অবস্থা রাঙামাটির সুভলং ঝরনা, বান্দরবানের শৈলপ্রপাত এবং বগা লেকে বিদ্যমান। জলার বন রাতারগুলকে নিঃশেষ করার কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনও রক্ষা পায়নি অবকাঠামো বিশেষজ্ঞদের হাত থেকে। সুন্দরবনের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আয়োজন চলছে পুরোদমে।
বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটন শিল্প বিকাশের কারণে বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে নিজস্ব কৃষ্টি ম্রিয়মাণ হতে চলেছে। পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের কারণে স্থানীয় জনগণকে পর্যটকদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করতে দেখা যায়। পর্যটকরা আদিবাসী তথা স্থানীয় ঐতিহ্য দেখে অবজ্ঞা করে। তবে অপরিসীম সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পরিবেশবান্ধব নীতিমালা আর বিদেশিদের জন্য বিশেষ এলাকা গড়ে না তোলায় দেশের অর্থনীতিতে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারছে না পর্যটন শিল্প। তাই জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান বাড়াতে, বাজেটে অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর উপযুক্ত পর্যটন নীতি প্রণয়নের আশা পোষণ করছি।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
লেখাটি ২৭/০৯/২০১৪ তারিখ বিশ্ব পর্যটন দিবসে ‘দৈনিক সমকাল’ এ প্রকাশিত।