বিষাক্ত বায়ুতে নাজুক উন্নত বিশ্ব এবং আমরাঃ পর্ব-১
দিব্য কান্তি দত্ত
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
-সুকান্ত ভট্টাচার্য্য
নবজাতকের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকার ছিল কবি সুকান্তের। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জঞ্জালমুক্ত এবং বাসযোগ্য এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য তার নিজের প্রজন্মকে নিয়ে প্রাণপণে জঞ্জাল সরানোর প্রচেষ্টায় আমরা কতটা সফল তা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবী বাসযোগ্য করার পরিবর্তে আমরা বরং তাদের জীর্ণ-শীর্ণ জঞ্জাল আর বিষাক্ততাময় পৃথিবীতে সংগ্রাম করতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কবির দেখা স্বপ্ন এখন অনেকটা কল্পনাই বটে! দূষণের ভারে জর্জরিত প্রজন্মের জন্মের আগেই প্রাণ নিয়েই যেখানে গুরুতর সংশয় সেখানে পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাবার স্বপ্নগুলোও তো দেখার আগেই হারিয়ে যাচ্ছে না ফেরার দেশে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদের অকাল জন্ম নিয়ে প্রকাশিত গবেষণায় যে শঙ্কার মাত্রাটা বেড়েছে বই কমেনি!
সম্প্রতি ‘এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পারস্পেকটিভস’ এ প্রকাশিত গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর বায়ুদূষণের কারণে প্রায় ১৬০০০ শিশুর অকাল প্রসব ঘটছে এবং এর ফলে তাদের বার্ষিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! এর মধ্যে ৭৬০ মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার জন্য এবং বাকি ৩.৫৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে অকাল জন্মদানের সাথে সম্পর্কিত শারীরিক এবং মানসিক অক্ষমতার জন্য। গবেষকদের মতে, বায়ুদূষণের ফলে মানুষের রক্তে বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে এবং তা শরীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যাহত করছে। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে তা ভ্রূণকে ধারণ করা গর্ভাশয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং এর ফলে অকাল প্রসবের ঘটনা ঘটছে।
শুধুমাত্র শিশুদের দিক থেকে যদি আমরা সরে আসি এবং পুরো পৃথিবীর জনসংখ্যাকে বিবেচনায় আনি তবে ভয়াবহতা কিন্তু কমে যাচ্ছে না। পুরো পৃথিবীতে প্রতিবছর বায়ুদূষণের ফলে মারা যায় প্রায় ৭০ লাখ মানুষ এবং এদের ভিতর অর্ধেকেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় ঘরের ভিতর সৃষ্ট বায়ুদূষণে! এই মৃত্যুর হার এশিয়ায় বেশি, কারণ ঘরের ভিতরে দূষণ প্রধানত সংঘটিত হয় কাঠ বা কয়লার চুলায় রান্না করার মাধ্যমে। বায়ুদূষণের ফলে হৃদপিন্ডের প্রদাহ থেকে শুরু করে ফুসফুস এবং মূত্রাশয়ের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। চীনকে বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর প্রায় ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। গবেষণা থেকে দেখা গেছে, চীনে বায়ুদূষণের কারণে এক বছরে মায়ের গর্ভেই মৃত্যু হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ শিশুর!
‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)’ এর পরিবার, মহিলা এবং শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ক শাখার পরিচালক ড. ফ্ল্যাভিয়া বুস্ট্রিওর মতে, “বায়ু পরিষ্কার রাখার মাধ্যমে আমরা দূরারোগ্য ব্যাধির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারি এবং একইসাথে শিশু এবং বয়স্কদের মত দূর্বল শ্রেণি এবং মহিলাদের রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমিয়ে আনতে পারি”। তার মতে, গরীব পরিবারের মহিলা এবং শিশুরা অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণের প্রধান শিকার কারণ, তারা বাসায় অধিকাংশ সময় কয়লা এবং কাঠ থেকে নির্গত ধোঁয়ার ভিতর কাটায়। ‘হু’র জরিপ অনুযায়ী ২০১২ সালে শহর এবং গ্রাম্য এলাকা থেকে বাইরের বায়ুদূষণে মৃত্যুর পরিমাণ প্রায় ৩৭ লক্ষ।
‘হু’ সারাবিশ্বের ১৬০০ শহরের ওপর জরিপ করে বায়ুর উৎকর্ষের মাত্রা পরিমাপ করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে। এছাড়া তারা গৃহস্থালির জ্বালানী থেকে সংঘটিত বায়ুদূষণ রোধ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। ‘হু’র জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের সামাজিক নিয়ামক বিভাগের সমন্বয়ক ড. কার্লোস দোরা’র মতে, “অতিরিক্ত বায়ুদূষণ পরিবহন, শক্তি, শিল্পকারখানা এবং বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ খাতে অদক্ষতার ফলাফল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, কার্যকরী পদক্ষেপগুলো সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল হবে কারণ, এখান থেকে আমরা একইসাথে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত খরচ কমানোর পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য আনতে চাই”। ‘হু’ বায়ুদূষণের বৈজ্ঞানিক কারণগুলো বিবেচনা করে এগুলোকে নীতিমালার আওতায় আনবে যা পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত এই গবেষণা অনুযায়ী বায়ুদূষণের মুল খাতগুলো হল- পরিবহন, শিল্পকারখানা এবং পরিত্যাক্ত বর্জ্যভূমি। গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক এবং ‘নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাংগন মেডিক্যাল সেন্টার’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিওনার্দো ট্রাসেন্ড এর কাছ থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে অকাল জন্মদানের পরিমাণ ২০০৬ এ থাকা ১২.৮ শতাংশ থেকে কমে ২০১৩ তে ১১.৪ শতাংশ হয়েছে। তবে এখনও তা অন্যান্য উন্নত দেশের চেয়ে অনেক বেশি বলে তা তাদের উদ্বেগের কারণ।
যুক্তরাষ্ট্র যেখানে বায়ুদূষণে অকাল প্রসব এবং আর্থিক ক্ষতি নিয়ে চিন্তিত সেখানে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের অবস্থা আরও করুণ হবে তা বলাই বাহুল্য। পার্থক্যটা হল, উন্নত দেশগুলো তাদের দেশে এই নূন্যতম হার নিয়েও শঙ্কিত, কিন্তু আমাদের দূষণে পরিপূর্ণ দেশে ‘ঢাকা’র মত ‘বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য’ ‘শীর্ষ’ একটি শহর থাকা সত্ত্বেও আমাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। আমাদের দেশের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ঢাকার এই দূরাবস্থা নিয়ে আলোচনা হবে পরের পর্বে…