বিষাক্ত বায়ুতে নাজুক উন্নত বিশ্ব এবং আমরাঃ পর্ব-২
দিব্য কান্তি দত্ত
গত পর্বে কথা হয়েছিল, অকাল প্রসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত গবেষণাপত্র নিয়ে এবং সেইসাথে বর্তমান বিশ্বে মৃত্যুহার বৃদ্ধি এবং অকাল প্রসবের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব নিয়ে। এই পর্বের শুরুতেই বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিতে বায়ুদূষণ কতটা ভূমিকা রাখে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ঘরের বাইরের বিভিন্ন উৎস থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণ নিম্নোক্ত রোগগুলো সংঘটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে-
- রক্তসল্পতা সম্পর্কিত হৃদপিন্ডের অসুখ- ৪০%
- স্ট্রোক- ৪০%
- ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগ- ১১%
- ফুসফুসের ক্যান্সার- ৬%
- শিশুদের তীব্র শ্বাসজনিত সংক্রমণ- ৩%
ঘরের ভিতরে সৃষ্ট বায়ুদূষণ নিম্নোক্ত রোগগুলো সংঘটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে-
- স্ট্রোক- ৩৪%
- রক্তসল্পতা সম্পর্কিত হৃদপিন্ডের অসুখ- ২৬%
- ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগ- ২২%
- শিশুদের তীব্র শ্বাসজনিত সংক্রমণ- ১২%
- ফুসফুসের ক্যান্সার- ৬%
‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ প্রদত্ত উপরোক্ত পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুধাবন করা যাচ্ছে যে, আমাদের গুরুতর রোগগুলো সংঘটনে বায়ুদূষণ কতটা প্রভাব ফেলছে। ২০১২ সালে অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণেই মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৪৩ লাখ লোকের। এ থেকে এবার আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় ঢাকা মহানগরীর কথায় আসতে পারি। দেশের আট ভাগ লোকের প্রায় এক ভাগ ধারণ করা এই মহানগরীতে দূষণের উৎসের অভাব নেই। যানবাহন, শিল্পকারখানা, পরিত্যক্ত বর্জ্যভূমি, হাসপাতাল, নির্মাণক্ষেত্র থেকে শুরু করে অনেক ক্ষুদ্র উৎস ঢাকা মহানগরীর দূষণের জন্য দায়ী।
গত পর্বের আলোচনা থেকে দেখা যায়, পুরো যুক্তরাষ্ট্রে বছরপ্রতি বায়ুদূষণে অকাল জন্ম হচ্ছে ১৬০০০ শিশুর। চীনের মত বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশে জন্মের আগে মায়ের গর্ভেই মারা যাচ্ছে ৫ লাখ শিশু। সেখানে শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীকেই হিসাবে আনলে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর জন্মের আগেই মায়ের গর্ভে মারা যায় প্রায় ১৫০০০ শিশু! ‘ডিপার্টমেন্ট অফ এনভায়রনমেন্ট (ডিওই)’ এর তথ্যানুযায়ী ঢাকায় প্রতি ঘনমিটারে বস্তুকণার পরিমাণ ৪৬৩ মাইক্রোগ্রাম। প্রতি ঘনমিটারে ৩৮৩ এবং ৩৬০ মাইক্রোগ্রাম নিয়ে এরপরই অবস্থান যথাক্রমে মেক্সিকো সিটি এবং মুম্বাইয়ের। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ প্রদত্ত মানদন্ড অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটারে বস্তকণার পরিমাণ থাকার কথা ২০ মাইক্রোগ্রাম এবং তা ৭০ মাইক্রোগ্রামে পৌঁছালেই সেই এলাকাকে তীব্রভাবে দূষিত এলাকার তালিকায় আনা উচিত। শুষ্ক মৌসুমের সময় ঢাকার বাতাসে এই পরিমাণ বস্তকণা পুরো বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে ঢাকা বসবাসের কতটা অযোগ্য।
এসব বস্তুকণার মধ্যে রয়েছে সীসার মত বিষাক্ত উপাদান যাকে সবচেয়ে ক্ষতিকর বিবেচনা করা হয়। বরিশাল মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান হুমায়ূন কবিরের মতে, “ফুসফুস এবং রক্তে মিশে সীসা মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়া তা হৃদরোগ এবং মূত্রাশয়ের রোগ সৃষ্টির পাশাপাশি শরীরে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে”। শিশুদের অকালমৃত্যু সম্পর্কে তিনি বলেন, “সীসার বিষক্রিয়ার কারণে শিশুদের মায়ের গর্ভে অস্থিতিশীল অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় এবং এর ফলে তাদের সেখানেই মৃত্যু ঘটে অথবা ক্ষীণ বুদ্ধি নিয়ে জন্মগ্রহন করে”।
জাতীয় বক্ষব্যাধি প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লক্ষ লোক অ্যাজমায় ভোগে এবং এদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিশু। এছাড়া বর্তমান সময়ে শিশুদের ব্রঙ্কাইটিস এবং দীর্ঘস্থায়ী কফের সমস্যাও ত্বরান্বিত হয়েছে। শিশুকল্যাণ সংস্থা ‘কচি কাচার মেলা’র প্রধান খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “শিশুরা তাদের ফুসফুসের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে বেশি শ্বাস গ্রহণ করে। তারা দিনের মধ্যভাগ এবং বিকেলেই ঘরের বাইরে বেশি কাটায় যখন দূষণের মাত্রাটা সর্বোচ্চ থাকে”।
বস্তুকণার আকৃতি যত ছোট হয় তা তত বেশি ক্ষতিকর হয়। সাধারণত ১০ মাইক্রোমিটার বা তারচেয়ে ছোট ব্যাসার্ধের বস্তুকণাকে ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তারচেয়ে ছোট ব্যাসার্ধের বস্তকণাকে বিবেচনা করা হয় তীব্রভাবে ক্ষতিকর হিসেবে। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০০৩ সালে ঢাকার বাতাসে ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তারচেয়ে ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধের বস্তুকণার পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৬৬ মাইক্রোগ্রাম যা ২০০৪ এ নেমে হয় ১৪৭ মাইক্রোগ্রাম। ২০০৭ এ তা ছিল ১৯১.৮৩ মাইক্রোগ্রাম যা বর্তমানে আরও বেশি।
‘নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাংগন মেডিক্যাল সেন্টার’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিওনার্দো ট্রাসেন্ডের মতে, “বায়ুদূষণ শুধু মানুষের জীবনই নয় সমাজের আর্থিক বোঝা বাড়িয়ে দিয়ে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে”। যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশে বায়ুদূষণ যখন সমাজের মানুষকে তটস্থ করে তুলেছে সেখানে আমরা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হয়েও এ বিষয়ে ভাবলেশহীন। শিশুদের অকাল মৃত্যু এবং রোগের দ্রুত বিস্তার আমাদের সমাজের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে এ বিষয়ে আমরা অবগত। একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য মেধা এবং জনবল অনেক বড় সম্পদ। উপরোক্ত পরিসংখ্যান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বিষয়টা বিবেচনায় এনে অতিসত্ত্বর পদক্ষেপ নেয়া কতটা জরুরী। আরো কিছুটা দেরী হয়তবা ভুল সংশোধনের সুযোগটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে।