বিদেশী কচ্ছপ রেড ইয়ার্ড স্লাইডার: শখের দামে বিপদ আনছি নাতো!
স্বভাবে লাজুক। কাছে গেলেই গুটিয়ে যায় খোলের ভিতরে। অনেকটা লজ্জাবতী লতার মতন। সবুজ-লাল-নীল-হলুদের বিচিত্রবর্ণ প্রাণীটিকে দেখলেই যে-কারও ভাল লেগে যাওয়ার কথা। সাধারণত বাংলাদেশের অ্যাকুরিয়ামের দোকানগুলোতে যেই কচ্ছপগুলো বিক্রি করা হয় তাদেরই নাম Red Eared Slider। এদের এমন নামের কারন হলো এদের কানের পাশে লাল রঙের একটা দাগ থাকে। আর এরা মানুষ বা কোনো বড় প্রানী দেখলেই তারা পানিতে দ্রুত গতিতে নেমে যায় ।
এই কচ্ছপ গুলো পুরোপুরি জলচর না, অনেকে এদের একুরিয়ামে শুধু পানিতে ছেড়ে রাখেন, এটা ভুল। এদের বলা হয় অর্ধজলজ(semi-aquatic) বা নদীচর কচ্ছপ(Terrapin)। তারা সাধারণত শান্ত পানিতে থাকে। রেড ইয়ারড স্লাইডার এর জন্য শরীরে সূর্যের আলো পৌঁছানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুকুর , নদী, খালের আশে পাশে কোনো পাথর এর উপর প্রায়ই এদের বসে থাকতে দেখা যায় । গাছ গাছালি যুক্ত জায়গা এরা বেশি পছন্দ করে। এরা চমৎকার সাতারু। মেয়ে রেড ইয়ারড স্লাইডার ছেলেদের চেয়ে লম্বায় বড় হয়। পরিণত বয়সে মেয়ে কচ্ছপ লম্বায় প্রায় ১২ ইঞ্চি হয় এবং ছেলেগুলো হয় ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি। মেয়ে কচ্ছপের হাত পায়ের নখ ছেলেদের থেকে তুলনামূলক ভাবে ছোট হয়। ছেলেগুলোর লেজ বেশি মোটা ও লম্বা হয়। রেড ইয়ারড স্লাইডার বাচ্চা অবস্থায় carnivorous অর্থাৎ মাংশাসী থাকে। শাক সবজি খেতে চায় না! যত বড় হয় তত তারা তৃণভোজী(vegetarian) হয়ে যায়!
এরা বিশেষ প্রজাতির কচ্ছপ। আচার-আচরণ অন্যান্য প্রজাতির কচ্ছপদের মতোই। কিন্তু আমাদের দেশে তাদের উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত পরিবেশবিজ্ঞানীরা। পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন , এই কচ্ছপ যদি এক বার এ দেশের নদীনালায় ছড়িয়ে পড়ে, অচিরেই পরিবেশের বড় বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। নানান প্রজাতির কচ্ছপকে ঝাড়েবংশে লোপাট করে দেওয়াটা এদের কাছে জলভাত। এতটাই যে,এ দেশের কচ্ছপের বিলুপ্তিতে চোরাশিকারিদের থেকেও মারাত্মক হতে পারে এই বিচিত্রবর্ণ কচ্ছপ!
কেনই বা তারা এত বিপজ্জনক?
‘রেড ইয়ারড স্লাইডার’ আমেরিকার মিসিসিপি নদী উপত্যকার আদি বাসিন্দা। মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়াতেও এদের দেখা যায়। সাধারণভাবে এই কচ্ছপেরা পরিখাঘেরা এলাকায় নিজেদের প্রজাতির মধ্যে মিলেমিশেই থাকে। ভারতের বনকর্তারা জানান, সাধারণ পরিবেশ, নদীনালায় ছড়িয়ে পড়লেই তারা বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। বিপদটা আসে অন্যান্য প্রজাতির কচ্ছপের সঙ্গে তাদের প্রজননের সূত্রে। অন্যান্য শ্রেণির কচ্ছপের সঙ্গে তাদের মিলনের ফলে সংকর প্রজাতির কচ্ছপ জন্ম নেয়। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না-পেরে অচিরেই মারা যায় তারা।
সেখানেই যে বিপদটা শেষ হয়, তা কিন্তু নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানের এক শিক্ষক বলছেন, ‘‘যে-সব কচ্ছপ নদীনালার আদি বাসিন্দা , স্লাইডারের প্রজননের ফলে তারাও বিপন্ন হয়ে পড়ে।’’ বহিরাগত ওই সব কচ্ছপের খাবার জোগাতে গিয়েও ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবেশ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র জানান, এই কচ্ছপগুলি মাটি বা জল-কাদা থেকে নাগাড়ে কেঁচো, পোকা, শামুক খেতে থাকে। বড় এলাকা জুড়ে এরা ছড়িয়ে পড়লে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয়। নির্বিচারে কেঁচো, পোকা খাওয়ার জেরে মাটির পচনক্ষমতাও কমে যায়। যার ফলে অনেক বর্জ্য পদার্থ মাটিতে বা প্রকৃতিতে মিশে যেতে পারে না।
পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন ধ্বংসাত্মক স্বভাবের জন্যই রেড ইয়ারড স্লাইডার প্রজাতির কচ্ছপকে বিশ্বের ১০০টি ক্ষতিকর প্রজাতির তালিকায় রেখেছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)। এই বিপজ্জনক প্রকৃতির জন্য আমেরিকায় এদের পরিখাঘেরা পুকুরের মধ্যে রাখা হয়।
এই কচ্ছপ বাংলাদেশে আসলো কী করে?
এই ধরনের কচ্ছপের আকর্ষণ এদের বিচিত্রবর্ণ সৌন্দ্যর্যে। দেখতে সুন্দর বলে গোটা বিশ্বের বাজারেই পোষ্য হিসেবে এদের চাহিদা ব্যাপক। ব্যবসায়ীরা মুনাফার লোভে অন্যান্য পশুপাখির মতো এদেরও আমদানি করে। এ ভাবেই আমেরিকা থেকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে স্লাইডার কচ্ছপ। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে এদের প্রজননের খামার রয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রানিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শায়ের মোহাম্মাদ ইবনে আলম জানান,এই প্রজাতির কচ্ছপ আমাদের পরিবেশের উপর কি আদৌ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে নাকি আমাদের দেশিও প্রজাতির কচ্ছপের সাথে খাপ খাইয়ে নিবে,তা নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন গবেষণা করা হয়নি। তবে তিনি জানান,তাইওয়ানে এরা বংশবিস্তার করলেও তাদের সংখ্যা ছিল সীমিত। কিন্তু ইরানে তারা এত বিস্তার করে যে, সেখানকার প্রজাতি হুমকির মুখে পড়ে যায়। তারপর থেকে ইরানে প্রবেশের উপর কঠোর নিষেথাজ্ঞা জারি করা হয়। যেহেতু তাইওয়ানের আবহাওয়া বা পরিবেশ অনেকটা বাংলাদেশের কাছাকাছি সেহেতু আদৌ তারা ক্ষতিকর কিনা তা একটু ভাবার বিষয় বলে মনে করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পুকুরে প্রায়ই দেখা যায় এই বিশেষ প্রজাতির ‘রেড ইয়ারড স্লাইডার’।
অনেকেই বাড়ির অ্যাকুরিয়ামে এই কচ্ছপ রাখেন। কিন্তু সমস্যা হয় বড় হয়ে যাওয়ার পরে। তখন ঘরে রাখতে অসুবিধে হয়। সেই কারণে কেউ যদি নদী বা খালবিলে এদের ছেড়ে দেয়, তখনই বিপন্ন হয়ে পড়বে পরিবেশ।’’