ভিটাভাঙ্গা'র পথে; আইলার তাণ্ডবনৃত্যের ছলা-কলা-বৃত্তান্ত! পর্ব-১
আসাদ রহমান
সহকর্মী কামাল ভাই যখন তার এমফিল গবেষণা সংক্রান্ত কাজে সাহায্য করার জন্য তার গবেষিত এলাকায় যাবার প্রস্তাবটা দিয়ে ফেললে, তখন আর তাঁকে না করতে পারলাম না। শুরুর দিকে যদিও না-ই করেছিলাম কারণ আইলা নিয়ে আমার বিস্তর গবেষনা কাজ করা আছে কিন্তু কামাল ভাই নাছোড় বান্দা, নানা ভাবে যুক্তি তর্ক দিয়ে এমনকি শেষ পর্যন্ত ম্যাপ একে বোঝাতে থাকলেন কেন আমার ‘ভিটাভাঙ্গা’ গ্রামে যাওয়া উচিত!
কামাল ভাইয়ের এমফিল গবেষণায় তিনি মূলত আইলা পরবর্তী সময়ে পশ্চিম উপকূলীয় জনপদ তথা খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের তিনটি গ্রামে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের টিকে থাকার কৌশলগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করছিলেন। যদিও আইলা পরবর্তী কোপিং বিষয়টা আমার জন্য নতুন কোন বিষয় ছিল না, তবে পরিশেষে আমি বেশ আগ্রহী হয়ে উঠি। কারন তিনি যখন তাঁর গবেষিত এলাকা গুলোর ভৌগলিক বিবরণ এবং জলবায়ু সংক্রান্ত ঝুঁকি গুলো ম্যাপের মাধ্যমে বুঝিয়ে বলছিলেন তখন তো আমি রীতিমত হতবাক হয়ে গেলাম! তাঁর গবেষণা এলাকা তথা তিনি আমাকে যে ‘ভিটাভাঙ্গা’ গ্রামে নিয়ে যেতে চাইছেন; তাঁর প্রদেয় মানচিত্র অনুযায়ী শুধু গ্রামটিই নয় বরং পুরো ইউনিয়নটি ৪/৫ টি বড় বড় নদী বেষ্টিত একটা দ্বীপ। সুন্দরবন এবং বঙ্গোপসাগরের পতিতস্থলের মোহনায় ভেসে থাকা যেন এক টুকরো ভূখন্ড। কামাল ভাইয়ের মতে এই ভিটাভাঙ্গা গ্রামটিতেই আইলা তার তাণ্ডবনৃত্য সব থেকে বেশি করেছে এবং এখন পর্যন্ত এই গ্রামটিই দেশের সবচেয়ে দূর্যোগ প্রবণ এলাকা হিসেবে তিনি মনে করেন।
মনে ধরে যাওয়া যুক্তিগুলোর সাথে লোভ দেখানো হিসেবে তিনি আরো জুড়ে দেন যৌবন হারিয়ে ফেলা চালনা বন্দর, ডলফিনের ডুব-সাতার দর্শন, নলিয়ান ফরেস্টে (সুন্দরবন) সন্ধ্যাকাশ দেখা ইত্যাদি ইত্যাদি।
বৃহস্পতিবার রাতটা নির্ঘুম কাটানোর পর শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে আমরা খুলনা থেকে দাকোপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। উন্নয়ন এবং অর্থনীতির নানান নীতি এবং দূর্নীতি সংক্রান্ত আলোচনা করতে করতে পশুর নদীর বাম পাড় ধরে এগুতে এগুতে কখন যে পানখালি এসে পড়েছি বুঝতেও পারি নি।
পানখালি জায়গাটা মূলত খুলনা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে পশুর, রুপসা আর ঝপঝপিয়া (আমার যদি ভুল না হয়) এই তিন নদীর মোহনায় অবস্থিত দাকোপ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এখান থেকেই মূলত তিন দিকে তিনটা নদী ভাগ হয়ে তিনদিকে চলে গিয়েছে। কপাল যদি নেহাতই মন্দ না হয় তাহলে এখান থেকেই অ্যাডভেঞ্চারের শুরুটা হয়ে যেতে পারে। ফেরী পারাপারের সময় হয়তোবা ভুস করে একটা ডলফিন ভেসে উঠে আপনাকে চমকে দিয়ে আবার পানির ভেতরে হারিয়ে যেতে পারে, তবে সেটা কপাল সাপেক্ষে।
নৌকা যোগে পারাপারের ব্যবস্থা থাকলেও ফেরীতে করে পার হওয়াটাই শ্রেয়। দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোকে ঠিক ভরসা করে ওঠা খুব বেশি বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। মূলত ফেরী পার হবার পরে থেকেই ওয়াটার ওয়াটার এভরি হয়ার, নট এনি ড্রপ টু ড্রিংক নামক ভিন্ন এক জগতে প্রবেশ করে ফেলবেন।
ফেরীতে করে পার হতে হতে মাথার উপর দিয়ে চলে যাওয়া বিদ্যুতের তারের উপর আটকানো লাল সাদা বল সদৃশ বস্তুগুলো মনে প্রশ্ন জাগাতে পারে। পানখালিতে নদীর এই অংশটায় আসলে সী-প্লেন ল্যান্ড করে। প্লেন যেন ল্যান্ড করতে গিয়ে এই তারের উপর ল্যান্ড করে না বসে তাই এই আয়োজন।
নদী পার হলেই আপনি মূলত চালনা পৌঁছে গিয়েছেন। চালনা’র অতীত জৌলুস সম্পর্কে সামান্য জানা থাকলে বর্তমান চালনাকে দেখে আপনি যারপনাই ব্যাথিত হবেন; আমি নিশ্চিত।
দীর্ঘদিন পূর্বে কিছু সময়ের জন্য হলেও এই চালনারও একটা টগবগে যৌবন ছিল কিন্তু ‘সারভাইবাল ফর দ্যা ফিটেস্ট’ নামক তত্ত্বের আওতায় সেই চালনা আজ জ্বরা-মৃতপ্রায়। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পরপর, সমসাময়িক কোরিয়ান যুদ্ধের সমাপ্তিতে সারা বিশ্বে প্রচুর পরিমান পাট এবং পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা অনুভূত হয়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে আমদানী-রপ্তানী সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে অধিক মনযোগি হয়ে ওঠে। তখন চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর একমাত্র এবং সীমিত আমদানী ও রপ্তানীর স্থান হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। পাকিস্তান নেভীর সী-ইন-সী অ্যাডমির্যাল জেফোর্ড দ্বিতীয় একটি সমুদ্র বন্দরের গুরুত্ব চরম ভাবে অনুভব করতে থাকেন এবং পি এন এস ঝিলাম ও জুলফিকার নামক জাহাজের নেভী কর্মকর্তার সাথে পশুর নদীতে ৬০ কিলোমিটার ঘুরে ঘুরে অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দরের চাপ কমানোর লক্ষে ‘চালনা’ কে নতুন একটি চ্যানেল হিসেবে আবিস্কার করে ফেলেন। ডিসেম্বর ১, ১৯৫০ হতে ‘চালনা বন্দর’ পাকিস্তান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রলায়ের অধীনে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কার্যক্রম শুরু করে। ১১ই ডিসেম্বর, ১৯৫০ ‘City of Lyons’ নামক একটি ব্রিটিশ পন্যবাহী জাহাজ চালনা বন্দরে প্রথম নোঙ্গর ফেলার মাধ্যমেই জমজমাট হতে শুরু করে চালনা বন্দর। শুরুর দিক থেকে চালনা বন্দরে কার্গোর নোঙ্গর সংক্রান্ত সমস্যা প্রকট আকারে দেখা দিতে থাকে। ১৯৫৩ সালের দিকে স্যার ক্লদ ইংলিশ নামক জনৈক ভদ্রলোক চট্টগ্রাম বন্দরের চ্যানেল সার্ভে করতে আসলে একই সাথে তিনি পশুর-শিবসা চ্যানেল সার্ভে করে চালনা বন্দরে নোঙ্গর সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হিসেবে বন্দরটি মংলায় স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। এবং তার রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ২০ জুন, ১৯৫৪ তে সমুদ্র বন্দরটি চালনা হতে মংলায় স্থানান্তরিত করা হয়।
সেই সমুদ্র বন্দর চালনায়; যেখানে একসময় দেশি-বিদেশি হাজারো বড় বড় জাহাজ পন্য খালাসের অপেক্ষায় ভীর জমাতো আজ সেখানে ছোট্ট একটা জেটি ছাড়া আর কিছুই নেই।
আর এই লঞ্চ ঘাটটি থেকে এখন ছোট ছোট দু-একটি লঞ্চ ছেড়ে যায় খুলনা কিংবা কয়রার উদ্দেশ্যে।
তবে এখনো যে দু একটি পন্যবাহী জাহাজ ভীরে না বিষয়টি তা নয়। অদূরে দু একটি জাহাজকে নোঙ্গর ফেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ছবিতে যে জাহাজটি দেখা যাচ্ছে সেটায় বাংলাদেশ এবং ভারত দুই দেশের পতাকা দেখে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলে কামাল ভাই আমাকে জানান যে এই জাহাজটি মূলত বাংলাদেশ থেকে পন্য নিয়ে ধরলা, ব্রহ্মপুত্র (কুড়িগ্রাম) হয়ে ভারতের উরিষ্যায় চলে যায়। যতক্ষন এটি বাংলাদেশের জলসীমায় চলে ততক্ষন এর চালক হিসেবে থাকেন বাংলাদেশি নাবিক আর ভারতীয় জলসীমায় ভারতীয় নাবিক। চালনা থেকে উড়িষ্যা যেতে ৫ থেকে ৬ দিন সময় লেগে যায়। সঙ্গী কামাল ভাই বেশ জান্তা মানুষ, দুনিয়ার তাবত বিষয় সম্পর্কে তাঁর বিস্তর জ্ঞান।
চালনা নিয়ে এতগুলো হতাশার মধ্যে আশার কথা হচ্ছে; দেশের মানচিত্রে দাকোপ উপজেলার মূল অংশের কোন চিহ্ন না থাকার কারণে তথা অংশটি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবার কারণে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো এখন চালনাতেই স্থানান্তর করা হয়েছে।
এবং একই সাথে সামুদ্রিক পন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কিছু প্রতিষ্ঠান এখনো এখানে টিকে রয়েছে। কিন্তু আমার গন্তব্য এই চালনা’তেই শেষ নয়। যেতে হবে আরো বহুদূর, ভিটাভাঙ্গা গ্রামের পথে, যেখানে আইলা এসে চালিয়ে গিয়েছিল তার তাণ্ডবনৃত্য।
(চলবে)
লেখক;
আসাদ রহমান,
সমাজ গবেষক।
One Comment