ভিটাভাঙ্গা'র পথে; আইলার তাণ্ডবনৃত্যের ছলা-কলা-বৃত্তান্ত! পর্ব-২
আসাদ রহমান
সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপ উপজেলাটি মূলত তার ভৌগলিক অবস্থানের কারনে তথা ঝপঝপিয়া, ভদ্রা, শিবসা, ঢাকি, চুনকুড়ি , পশুর ইত্যাদি নদী দ্বারা তিনটি পৃথক পৃথক দ্বীপে ত্রিখন্ডিত। পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬০ এর দশকে ৩১, ৩২ ও ৩৩ পোল্ডার নামে এই দ্বীপ ৩টির নামকরণ করে। দাকোপ সদর, পানখালী ও তিলডাংগা ইউনিয়ন নিয়ে ৩১ নং পোল্ডার, কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়ন মিলে ৩২ নং পোল্ডার আর দাকোপ, লাউডোব, কৈলাশগঞ্জ, বানীশান্তা ও বাজুয়া এই ৫টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে ৩৩ নং পোল্ডার গঠিত যার মানচিত্রে স্থলভাগের পরিমাণ দিন দিন চরম ভাবে কমে আসছে। কথিত আছে যে, দাকোপ এলাকাটি পূর্বে ঝোপ-জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল এবং কালক্রমে এই জঙ্গল কেটে আবাদী জমিতে পরিণত করে বসতি স্থাপন শুরু করা হয়। এখানকার ঝোপ-জঙ্গল দা দিয়ে কুপিয়ে নির্মূল করা হয় তাই এখানকার নামকরণ করা হয় দাকুপী। পরবর্তীতে দাকুপী নামের কিঞ্চিৎ সংশোধন হয়ে দাকোপ নামে পরিণত হয়। উপজেলাটিতে ৯ টি ইউনিয়নে প্রায় ১০৭ টি গ্রাম রয়েছে।
পুরো উপজেলার যেদিকে তাকানো যায় শুধু পানি আর পানি। এ যেন পানির রাজত্ব, আর এই পানির রাজত্বে সুপেয় পানির-ই তীব্র হাহাকার। এ যেন মানুষের সাথে বিধাতার অদ্ভুত এক প্রহসন। খাবার পানির প্রধান উৎসই হল এখানে বৃষ্টির পানি এবং পুকুর। কিন্তু আইলা পরবর্তী সময়ে বেশির ভাগ পুকুর-ই লবণ পানিতে নষ্ট হয়ে যাবার কারনে এলাকার পানির প্রধান উৎস এখন বৃষ্টির পানি আর নদী। দু-একটা নদীতে পানি ছয় মাস নোনা এবং ছয় মাস মিষ্টি থাকার কারণে এলাকার কিছু কিছু বাড়ির নলকূপের পাইপ গিয়ে ঠেকেছে নদীতে এবং সেই পানি ফিটকিরির সাহায্যে বিশুদ্ধ করে চলে পানাহারের কাজ।
তাছাড়া, এই অঞ্চলের মানুষেরা সাধারণত বৃষ্টির পানি মাটিতে, বড় মাটির পাত্র পুতে অথবা বড় পলিব্যাগে সংরক্ষন করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সামান্য অবস্থা সম্পন্ন মানুষেরা বড় প্লাস্টিকের ট্যাংকে (গাজী, মদিনা, অন্যান্য) বর্ষাকালে পানি ধরে রাখে এবং সারা বছর সেই পানি খাওয়া এবং রান্নার কাজে ব্যবহার করে। কিছু কিছু এন.জি.ও. থেকেও এই ট্যাংক গুলো এখন দরিদ্রদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। তবে এই পদ্ধতি পুরোপুরি ঘরে টিনের চালার উপস্থিতির উপর নির্ভরশীল।
খাবার পানির সমস্যার থেকে দাকোপের মানুষেরা যে সমস্যায় সব থেকে বেশি সর্বসান্ত হয় তা হল নদী ভাঙ্গন। নদী ভাঙ্গন যেন এই অঞ্চলের নিত্য- নৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি দাকোপের প্রাণকেন্দ্র পোদ্দারগঞ্জ খেয়াঘাট সংলগ্ন বাজার ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সবটুকু প্রায় চুনকুড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। উপকূল রক্ষায় সরকারের বিস্তর বিস্তর আয়োজন চোখে পড়লেও সেগুলো যে আদৌ কোন কাজে আসে না তা প্রথম নজরেই বোঝা যায়।
যাই হোক, যেমনটা বলছিলাম যে আমার গন্তব্য হল দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ইউনিয়নের ভিটাভাঙ্গা গ্রামে অর্থাৎ ৩২ নং পোল্ডার নামক দ্বীপের একটি ইউনিয়নে যেখানে কিনা সর্বনাশা আইলা তার সর্বশক্তি দিয়ে সর্বসান্ত করে দিয়েছিল পুরো জনপদ।
৩২ নম্বর পোল্ডারের সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়ন দুটি মূলত একটি দ্বীপ এলাকা। এর চারদিক ঘিরে রয়েছে শিবসা, ঢাকি ও ভদ্রা নদী। এটি উপকূলীয় এলাকার সবচেয়ে দক্ষিণের জনবসতির একটি যার দক্ষিণে রয়েছে সুন্দরবন। এটি বাংলাদেশের একটি দুর্গম এলাকা হিসেবও পরিচিত। উপজেলা সদরের সঙ্গে এই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বরাবরই নাজুক।
দাকোপ থেকে কিছুদূর এসে, ৩২ নম্বর পোল্ডারের পথে যেতে পাওয়া যাবে শিবসা, পশুর আর ঢাকী এই তিন নদীর মোহনা। আর এই মোহনা পার হতে হবে ছোট্ট একটা ট্রলারে। পার হতে হতে দেখা মিলবে ভুসভুস করে ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে যাওয়া কিছু ডলফিনের। আসলে দক্ষিনের এই অংশটা এক সময় ডলফিনের অভয়ারন্য হিসেবে বিবেচিত থাকলেও সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনার পর থেকে ডলফিনের সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলে এলাকাবাসীরা জানান এবং একই সাথে কিছু অসাধু ব্যাক্তি যারা হঠাৎ কোথা থেকে দুটো বড় বড় ইঞ্জিলচালিত নৌকা নিয়ে দ্রুত গতিতে হাজির হয়ে দ্রুততার সাথে ডলফিন শিকার করা জাল পেতে খুব দ্রুতই জাল গুটিয়ে চলে যায়! তারা কী পরিমাণ ডলফিন শিকার করে তাৎক্ষনিক জানা না গেলেও ডলফিনের সংখ্যা যে কমে আসছে তা এলাকাবাসীরা অনুধাবন করতে পারেন।
বাজারে দু একটা ছোট ছোট দোকান ছাড়া আর কিছুই নেই। যানবাহন হিসেবে দু একটা মোটর সাইকেল এবং নসিমনের দাঁড়িয়ে থাকার দেখা মিললেও সভ্য জগত থেকে যে খানিকটা দূরে চলে এসেছি তা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।
মূলত কামারখোলা বাজারে প্রবেশ করা মাত্র ভিন্ন এক অনুভূতি মনে কাজ করা শুরু করে দেয়। সব কিছু মিলিয়ে কেমন যেন এক ধরণের উত্তেজনা-ভয় মাখানো অনুভূতি। নতুন একটা গন্ধ হুট করেই নাকে এসে হানা দেয়। কেমন জানি মাতাল করে দেয়া। কিছুদূর গেলেই গন্ধ আর উত্তেজনা-ভয় মাখানো অনুভূতির বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যায় কারন আমরা ততক্ষনে সুন্দরবন এলাকায় প্রবেশ করে ফেলেছি যার প্রমাণ হল রাস্তার ধারে ধারে গজিয়ে ওঠা গোল গাছের সগৌরবের উপস্থিতি।
(চলবে…)
লেখাটির ১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক;
আসাদ রহমান,
সমাজ গবেষক।