চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; মন ভোলানো সবুজ প্রকৃতিতে একদিন!
মোঃ মাহে আলম
ছোটবেলা থেকে দূরন্তপনায় মন যখন পড়ার টেবিলে থাকতে চায়নি ঠিক তখনই মনে হত পাখির মত উড়াল দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই। আমন ধান কেটে শুকাতে দিলে তার উপর শুয়ে ভাবতাম পৃথিবীটা যেন কেমন! কাশফুলের গন্ধে, পড়ন্ত বিকেলে রাখালের সাথে গরু নিয়ে গোয়ালে ফেরা ও চরের ছোট্ট ঘরে বসে ধান পাহারা দেয়ার সময় হাজারো প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খেত। পূর্ব আকাশে চাঁদের সোনালী আলো দেখে বাবাকে বলতাম বাবা চাঁদ কী? বাবা বলত আমি হাল চাষ জানি কিন্তু চাঁদ কী তাতো জানিনা। তুই বড় হয়ে শিখে নিস। সবুজ প্রকৃতি, দিগন্ত বিস্তৃত আবাদি জমি কিংবা গাছের ডালে বসে ডাকা পাখি গুলো সবসময়ই আমার মন কাড়ত। অপলক তাকিয়ে থাকতাম সেদিকে। বাবা বলেছিল, আমি সারাজীবন চরে কাটালাম কিন্তু আমি চাই তুই সব সৌন্দর্য ঘুরে ফিরে দেখবি। জানিনা বাবার কথা কতটা রাখতে পেরেছি। তবে সুযোগ পেলেই বন্ধুদের সাথে প্রকৃতি দেখতে বের হই।
এইতো গত শুক্রবার জুমা’র নামাজ পড়ে বের হয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। সাধারণত আমরা দলবিহীন কোথাও যাইনা। কিন্তু সেদিন অনেকের ব্যস্ততা থাকায় আমার বন্ধু সাইফুলকে সাথে নিয়েই ছুটলাম পাহাড় ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দর্শনে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়টি চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী থানার ফতেহপুর ইউনিয়নের জোবরা গ্রামের পাহাড়ি সমতল ভূমির উপর অবস্থিত। এটি দেশের তৃতীয় বৃহত্তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। তার থেকে বড় কথা হল প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে নিজস্ব স্বকীয়তা প্রকাশের ক্ষমতা আমার মনে হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই আছে। আমাদের চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাস ও অটোরিকশা যোগে সেখানে পৌঁছুতে সময় লেগেছিল মাত্র এক ঘন্টা। অর্থাৎ যদি আপনি চট্টগ্রামের জিইসি থেকে যেতে চান তবে আপনার সময় লাগবে মাত্র ৪৫ মিনিট।
আমরা ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্টে প্রবেশ করা মাত্রই বুঝতে পারি কোন এক পাহাড়ঘেরা প্রকৃতিতে ঢুকতে যাচ্ছি। জিরো পয়েন্ট থেকে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা রাস্তা দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে যাই। সেখানে আমাদের পথপ্রদর্শক শারমিনের সাথে দেখা করি। শারমিন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী, আমার ছোট বোন। হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের বাস ভবনের সামনে যাই। শুরুটা শেখান থেকেই। আব্দুল জব্বার নামক পাহারাদারের সাথে কথা বললাম আমরা। চোখে না হয় পাহাড় দেখা যায় কিন্তু প্রাণিবৈচিত্রের দেখাটা নাকি পাবো রাতের বেলা, জানালেন পাহারাদার। হরিণ, বন্য শুকুর, বন বিড়াল, বানর, সাপ নাকি দেখা যায়। পরে শারমিনের কাছে জানলাম কথাটা সত্যি। তাই ইচ্ছা ছিল গভীর রাত পর্যন্ত থাকব। তবে সময় স্বল্পতার কারণে থাকা সম্ভব হয়নি।
যাই হোক, পড়ন্ত বিকেলে বসন্তের হাওয়ায় বিজ্ঞান অনুষদ পেরিয়ে যখন হাঁটতে থাকি পাখির কলকাকলি আমাদের মুগ্ধ করে তোলে। মায়াবী সাঁঝের পরিবেশে নিড়ে ফেরা পাখিরা যেন আমাদের গান শুনিয়ে তৃপ্তি পাচ্ছিল। শহীদ মিনার থেকে মাত্র বিশ মিনিট হেঁটে সোজা চলে যাই ক্যাম্পাসের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। গার্ডেনে নতুন নতুন উদ্ভিদের সাথেও পরিচিত হই। বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে যখন ছোট্ট ঝরনা দেখতে যাব তখন মাগরিবের আযান দিচ্ছিলেন মোয়াজ্জিন। আর সাথে সাথে বিভিন্ন প্রাণী ও পাখির ডাকাডাকি আরো বেড়ে যায়।
সাইফুল ক্যামেরায় প্রতিটি দৃশ্য খুব সুন্দরভাবে বন্দী করেছে। একটা কাঠবিড়ালির ছবি তুলতে টানা ত্রিশ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল সে। ব্যাটা কাঠবিড়ালি পাতার আড়াল থেকে লেজ বের করেছে কিন্তু পুরো শরীর বের করছেনা। পরে অবশ্য সে ছবি নিতে সমর্থ হয়। আবার একটি সাপ পানিতে ব্যাঙ ধরেছে। ব্যাঙের চিৎকার শুনে ক্যামেরা হাতে চুপচাপ ছবি তুলেছে। সাপ কিংবা ব্যাঙ বুঝতেই পারেনি তার উপস্থিতি। তাদের যাতে কোন সমস্যা না হয় সেভাবেই তো আমাদের চলা উচিৎ। সাঁঝের বেলা পাখিদের গাছের ডালে ঝাঁক বেঁধে বসে থাকার দৃশ্য, সবুজ গাছপালা সবই আমাদের মন কেড়েছে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আপনাদেরও মন কাড়বে।
গোধুলী পেড়িয়ে গেলে আস্তে আস্তে পথের ধারে জ্বলে ওঠে সোডিয়াম বাতিগুলো। মনে হচ্ছিল দূরে কোথায় পাহাড়ের গুহায় জোনাকি পোকা জ্বলছে। আমরা তিনজন যখন শহীদ মিনারে বসে আনারস খাচ্ছিলাম তখন রাতের নির্জনতা একটু একটু করে বাড়ছিল। শারমিনকে বিদায় দিয়ে আমরা আমাদের ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। ফেরার পথে বাবার সেই আকাংক্ষার কথা মনে পড়ছিল। প্রকৃতি দর্শনের কথা… তবে আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের খাতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটিও উজ্জ্বল হয়ে থাকবে আজীবন।
লেখক: ইন্টার্ণশীপ শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)।