আফ্রিকান ভুভুজেলা এবং আমাদের বৈশাখ সংস্কৃতি!
ফারজানা হালিম নির্জন
দিন বদলাচ্ছে। সময়কে চাইলেও প্রিয় মুহুর্তে থামিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কোন এক অজানা বাঁশির সুরে সবাই ছুটছে তো ছুটছেই। সুখ প্রায় অধরা হতে হতে যখন আবছা হতে থাকে, প্রাণের কাছে ফিরে আসতে হয় তখন, একটুখানি অবসর আর অকৃত্রিম শান্তির আশায়। সে যাই হোক, বাংলাদেশিদের কিন্তু আনন্দের খোরাকের অভাব নেই! ঐ যে কথায় বলে, বাঙ্গালীর বারো মাসে তের পার্বণ! আর এতো এতো উৎসবকে নানান রঙ্গে নানান ঢঙ্গে কত জাঁকজমকভাবেই না পালন করেন বাঙ্গালীরা। দু’দিন আগেই যেমন বরণ করে নেয়া হলো বাংলা নতুন বৎসর, ১৪২২ সন কে।
যাক পুরাতন স্মৃতি/ যাক ভুলে যাওয়া গীতি/ যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক… ঠিক তাই! পুরনো যা কিছু অসুন্দর, সবকিছুকে পেছনে রেখে, সব কষ্টের স্মৃতি ভুলে গিয়ে পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরকে নতুন স্বপ্নে মুড়িয়ে বরণ করে নেই আমরা। বাঙ্গালীর ঐতিহ্য মিলেমিশে একাকার এই উৎসবের দিনটি ঘিরে। বৈশাখি মেলা্র আয়োজনে থাকে নাগোরদোলা, পুতুল নাচ, যাত্রা… ডুগডুগি, বাঁশের বাঁশি, পাতার বাঁশি, পাখা, শীতল পাটি, ডালা-কুলা, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল, ঘুড়ি, কাগজের পাখি, কাগজের নৌকা, বাঁশ-বেতের তৈরি হস্তশিল্প, শঁখের হাঁড়ি এই সেই কত কী যে আরো থাকে! এছাড়া মুড়ি-মুড়কি, মোয়া, মুড়ালি, বাতাসা…এসব ছাড়া তো মেলা জমেই না! গ্রাম্যমেলার ধাঁচ ধীরে ধীরে আমরা নগরবাসীরাও হই হই রই রই করে গ্রহণ করে নিলাম। কেনই বা বঞ্চিত হবো! ঢাকাবাসীদের নববর্ষের উদযাপন বিভিন্ন ভঙ্গিমায় হলেও একটা ছঁকে বাঁধা পড়ে গেলো। প্রথম ভোরের মিষ্টি আলোয় রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ, এরপর শহুরে বৈশাখি মেলায় টুকিটাকি আনন্দের বাজার সদাই। ছেলেরা পাঞ্জাবী, মেয়েরা শাড়ি পড়ে ঘুরে বেড়ায় আর মেলায় মেতে উঠে গানের মায়ায়, প্রাণের উচ্ছ্বাসে। নানান বয়সী মানুষের আনাগোনা আর পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে মেলার প্রাঙ্গণ। আচ্ছা বলুন তো, এর মধ্যে আফ্রিকান ভুভুজেলা কোত্থেকে ঢুকে পড়লো? কেমন বেমানান লাগছেনা শব্দটা? ‘ভুভুজেলা’ শব্দ থেকে বেরিয়ে এবার আসি ভুভুজেলার সেই প্রাণ যায় যায় অবস্থার বিকট শব্দে!
মানুষের শ্রবনসীমার স্বাভাবিক মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল প্রায়। আর ভুভুজেলার শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবেলের উপরে। তো, যদি একসাথে অনেকগুলো ভুভুজেলা বাজে, তখন? ১০০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে যায়। আফ্রিকার এই উদ্ভট বাঁশি (!) ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের পর থেকে বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শহরে, গ্রামে কোথায় নেই এই ভুভুজেলার অত্যাচার! বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই শ্রবনসীমা অতিক্রমকারী স্থানে কিছুক্ষণ সময় অবস্থান করলেই, শিশুরা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। আর যেকোনো বয়সী মানুষের জন্যই এটি বেশ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে, প্রথমত খিটখিটে মেজাজ, অতঃপর স্নায়বিক অসুস্থতা, হৃদরোগ থেকে শুরু করে আরো বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউ। তাহলে সমাধান কী? এই ধরণের অসুস্থ পরিবেশ থেকে দ্রুত প্রস্থান। কিন্তু সেটি কি আদৌ সম্ভব? আমরা কি এই ভুভুজেলার হাত থেকে বাঁচার জন্য উৎসব উদযাপন থেকে বিরত থাকবো? ভয়ংকর হলেও সত্যি, অনেকেই একমাত্র ভুভুজেলার বিকট শব্দে অতিষ্ট হয়ে তীব্র মাথা ব্যাথা নিয়ে বাড়ি ফেরেন, কিংবা কেউ কেউ উৎসবে সামিলই হন না! বাঙ্গালীর এমন প্রাণের উৎসবে এ কেমন দুর্যোগ! ২০-৩০ টাকা দামের এই প্লাস্টিকের পণ্যের কাছে আমরা এতোটা নিরুপায় হয়ে পড়ছি! ভুভুজেলার শব্দের ভেতর যেন বৈশাখের রাজ পোশাকে নেমে আসা রৌদ্রের উপস্থিতিও বেশ অস্বস্তির তীব্রতা ধারণ করছে। কোথায় হারিয়ে গেলো সেই ডুগডুগির আওয়াজ? কোথায় হারিয়ে গেলো সেই লক্ষ প্রাণের কলোরব? কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের জন্য বৈশাখি মেলার সাজ-সজ্জা সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো! শুধু ললনা কেন, কোনো মানুষেরই রেহাই নেই এই বখাটে ভুভুজেলার অত্যাচারে!
বৎসরের আবর্জনা, দূর হয়ে যাক, যাক, যাক, এসো এসো… এসো হে বৈশাখ, এসো এসো… এ বৎসর নাহয় একটু কষ্টেই শুরু করতে হলো, তবে আগামী পহেলা বৈশাখে নিশ্চয়ই এই আবর্জনা থেকে মুক্ত হবে নগর-বন্দর, গ্রামের মুক্ত বাতাস। ভুভুজেলা কে বৎসরের আবর্জনা বলাতে খুব বেশি ভুল নিশ্চয়ই হচ্ছে না?