উষ্ণতম ছয় মাসঃ জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার অন্য রূপ
মনিজা মনজুর
আপনি কি জানেন গত ছয়টি মাস আপনি আপনার জীবনের সবচেয়ে উষ্ণতম ছয়টি মাস পার করেছেন? রোজকার ব্যস্ততায় সময় কোথায় আমাদের এ নিয়ে ভাবার? আমরা তো পাখা আর এসি চালিয়েই ক্ষান্ত দেই!! কিন্ত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীটাই যে এখন একটা অগ্নিকুন্ডের উপর বসে আছে, তা কি আমরা জানি?
জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বর্তমানের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এর প্রতিকারের সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই ঘটে যাচ্ছে ভয়াবহতম ঘটনা। তারই সূত্র ধরে বলা যায়, ১৮৮০ সালের পর থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম ছয়টি মাস হল ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। সম্প্রতি নাসা (NASA) এর Global Land-Ocean Temperature Index এবং National Oceanic and Atmosphere Administration এর National Climatic Data Center এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
NASA এর এই ম্যাপটিতে ১৯৫১ এবং ১৯৮০ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রার সাথে সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালের গড় তাপমাত্রার পার্থক্য দেখানো হয়েছে। ম্যাপের নিচের স্কেল থেকে বুঝানো হয়েছে যত হলুদ থেকে কমলা, কমলা থেকে লাল রঙের দিকে যাবে, তাপমাত্রার পার্থক্য ওই অঞ্চলে তত বেশি। আর বামদিকের রঙগুলো নিম্ন তাপমাত্রার অঞ্চল নির্দেশ করে। তাপমাত্রার পার্থক্য সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে আর্কটিক এবং অ্যান্টার্কটিক অঞ্চলে।
এখানে দেখা যায়, পৃথিবীর কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আবার অন্যদিকে কিছু অঞ্চল অস্বাভাবিক রকম ঠান্ডা। আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে এক এক অঞ্চলের তপমাত্রায় তারতম্য দেখা যায়। যেমন, আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু জায়গায় তাপমাত্রার পরিমাণ ছিল গড় সীমারেখার নিচে, আবার দেখা যায় সেপ্টেম্বরে তাপমাত্রার পরিমাণ পুরো যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে গড় সীমারেখার উপরে অবস্থান করছে।
গবেষনায় দেখা গেছে বিগত ৪০০০ বছরের মধ্যে ২০১৪ এর সেপ্টেম্বর মাস ছিল তাপমাত্রার সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দেওয়া মাস। এপ্রিল,মে,জুন,আগাস্টও উষ্ণতম মাস,তবে জুলাই ছিল চতুর্থ উষ্ণতম মাস। অর্থাৎ বৈশ্বিক তাপমাত্রা তার সীমা অতিক্রম করে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাতে চলেছে যা মানব জাতি কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বরে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৩৯৫.২৮ পি পি এম, যেখানে ১৯৮৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৩৫০ পি পি এম!!
২০০৯ সালে ‘UN Framework Convention on Climate Change’ এ বিশ্বনেতারা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে একমত হয়েছিলেন যাতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিমাণ ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর বেশি না হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান মতে, শতাব্দী শেষ হয়ে যাচ্ছে, অথচ কমানো যাচ্ছে না উষ্ণতা। ২ ডিগ্রী পর্যন্ত ধরে রাখা তো দূরের কথা! তারই ধারাবাহিকতায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী বারবার আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছে বন্যা, দাবানল, ঝড়, খরা, দুর্ভিক্ষ সহ আরো অনেক প্রাকৃতিক দূর্যোগ দ্বারা।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়াতে গড় তাপমাত্রা ভূ-পৃষ্ঠ অপেক্ষা সমুদ্রের বেশি ছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানীরা পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রে ‘Mega- drought’ এর সম্ভাবনার কথা বলেছেন যা কি না পুরো একটি শতাব্দী পর্যন্ত বিরাজমান থাকতে পারে। কারণ ক্যালিফোর্নিয়াতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় কম। ধারণা করা হয়, পরবর্তী বছর থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ‘এল-নিনো’ ও ভূমিকা পালন করবে। National Oceanic and Atmosphere Administration এর Climate Prediction Center এর মতে, শরৎ অথবা শীতকালে দূর্বল প্রকৃতির এল-নিনো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৬০-৬৫%।
অন্যদিকে, মজার ব্যাপার হলো, সেপ্টেম্বর মাস ছিল জলবায়ু পরিবর্তনে অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলনের মাস। UN Climate Summit কে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী People’s Climate March অনুষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রের খরা আর ভারতের প্রবল বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহ সংঘটিত হয়েছে এই সেপ্টেম্বর মাসেই!!
বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে এই কথা জানা স্বত্তেও উন্নত রাষ্ট্রগুলো কার্বন নিঃসরন লক্ষ্যনীয় ভাবে কমিয়ে আনতে পারে নি।। বাংলাদেশ কার্বন নিঃসরনের জন্য দায়ী না হয়েও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরোক্ষভাবে। যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে শীঘ্রই আরো নতুন দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হবে বিশ্ববাসীকে। যার তীব্রতা হয়ত কল্পনারও অতীত!!