পবা’র গোল টেবিল বৈঠকে বক্তারা
জলাবদ্ধতা মহাবিপর্যয়ের পদধ্বনি
ঢাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড, মাস্টার প্ল্যান ও ড্যাপকে উপেক্ষা করে অপরিকল্পতিভাবে হচ্ছে। পানি, পয়ঃবর্জ্য, যোগাযোগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অবকাঠামোসহ অন্যান্য সকল অবকাঠামো অপরিকল্পিতভাবে এবং নিম্নমানের হচ্ছে। পানি ও পানি নিষ্কাশনের অভাব, পয়ঃবর্জ্য ও অন্যান্য বর্জ্য অব্যবস্থাপনা, যানজটসহ নানাবিধ সংকটে ক্রমান্বয়ে এক মহাবিপর্যয়ের দিকে ছুটছে এই মহানগরী। বর্তমান জলাবদ্ধতা তারই বহিঃপ্রকাশ। প্রয়োজন সামগ্রিক ভাবনা। শুধু প্রকল্পের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় ‘নগরে মহাবিপর্যয়ের পদধ্বনি, জলাবদ্ধতাঃ “উন্নয়ন ভাবনা” ও কর্তৃপক্ষের দায়’-শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র উদ্যোগে ২৯ জুলাই ২০১৭, শনিবার, সকাল ১১টায় পবার নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরী, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসানাত, পবা’র সহ-সম্পাদক স্থপতি শাহীন আজিজ, এম এ ওয়াহেদ, নিশাত মাহমুদ, জাহাঙ্গীর যুবরাজ, পবা’র সদস্য রাজিয়া সামাদ, সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, সদস্য প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ, অমূল্য কুমার বৈদ্য, বানিপা’র সভাপতি আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, সকল মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রধান অফিস ঢাকায়। বিদ্যুৎ, গ্যাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা মহানগরীর সাথে অন্য কোনও নগরীর তুলনাই হয় না। উন্নয়ন কর্মকান্ডও অসমভাবে কেন্দ্রীভূত। তদুপরি, রাজউক কর্তৃক নামমাত্র মূল্যে প্রভাবশালীদের ঢাকায় প্লট-ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা। উপজেলা, জেলাসহ অন্যান্য এলাকার জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক নেতৃবৃন্দ সপরিবারে ঢাকায় বসবাস করে। এছাড়াও নানাবিদ কারনে ঢাকামূখী জন¯্রােত। রাজউক, সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসাসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে মূল দায়িত্ব পালনে উদাসীন থাকলেও ব্যস্ত প্রকল্প ভাবনায়। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে শহরের জনসংখ্যা ও আয়তন। জনসংখ্যা এখন ১ কোটি ৮০ লাখ। হিসাবনিকাশ বলছে, ২০৩৫ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সাড়ে ৩ কোটি জনসংখ্যার শহরে পরিণত হবে ঢাকা। আগামী ১৮ বছরে যদি ঢাকার জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়, তাহলে ঢাকার অবস্থা কী দাঁড়াবে? এসব না ভেবে মহানগরী ঢাকা-কে নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মতো করে প্রকল্প গ্রহণ করে এবং তা পাসও হয়। সেগুলো নিজেদের মতো করে বাস্তবায়নও করে ফেলে। পুরো নগর ও পরিবহন পরিকল্পনার সঙ্গে তা মিলছে কি না বা একটি আরেকটির জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে কি না, তা বিবেচনায় নেয়ার কেউ নেই। ঢাকা নগরের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, কোনোটি বাস্তবায়ন করছে রাজউক, কোনোটি সড়ক ও জনপথ। সত্যিই এক আজব পরিস্থিতি।
প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, যানজট, জলাবদ্ধতা, ঢাকা ও ঢাকার চারপাশের নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় এবং নিম্নাঞ্চল দখল-ভরাট-দূষণ, পয়ঃ বর্জ্য, কঠিন বর্জ্য ঢাকা মহানগরীকে মহাবিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাব। ঢাকা ওয়াসা ১৯৮৯ সাল থেকে ংঃৎড়স ধিঃবৎ ফৎধরহধমব-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত। এছাড়াও তাদের ৩টি মিশনের একটি হচ্ছে ংঃৎড়স ধিঃবৎ ফৎধরহধমব ংুংঃবস নিশ্চিত করা যা বর্তমানে ৩৭০ কিলোমিটার। অন্য দিকে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব হচ্ছে ংঁৎভধপব ফৎধরহধমব ংুংঃবস-নিশ্চিত করা যা বর্তমানে ২২৩০ কিলোমিটার। ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেল ও ড্রেনেজ আর এন ডি সার্কেলের জনবল ১২১জন। যারা গত কয়েক বছর ধরে কোন কাজ ছাড়াই বেতন ভাতাদি গ্রহণ করছেন। বিষয়টি কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নাগরিকরা ওয়াসার কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রত্যাশা করছে।
ওয়াসার বর্তমান ড্রেনেজ ব্যবস্থায় প্রতি ঘন্টায় ১৫ থেকে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও গত ২৬ জুলাই সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬ ঘন্টায় ৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে ঢাকা শহর পানিতে তলিয়ে যায়। যা কোন ভাবেই বোধগম্য নয়। এর প্রধান কারন ড্রেনেজ সিস্টেম অকার্যকর এবং ২৫০টি পাম্পের ৯০টি অকেজো থাকা। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের সারফেজ ড্রেনেজ অকার্যকর থাকাও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। এছাড়া বিভিন্ন খালে রাজউক থেকে অনুমোদন নিয়ে ইমারত নির্মাণও জলাবদ্ধতার কারণ। জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে স্বল্প মেয়াদী (সারফেজ ড্রেনেজ, ংঃৎড়স ধিঃবৎ ফৎধরহধমব সচল ও ওয়াসার পাম্পগুলো পরিচালনা করা), মধ্য মেয়াদী (বিদ্যমান খালগুলো দখলমুক্ত করে পানি প্রবাহ সৃষ্টি করা) এবং দীর্ঘ মেয়াদী বিলুপ্ত খাল সমূহ পূনঃরুদ্ধার করে স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা। সর্বোপরি নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানো। তিনি জলাবদ্ধতার জন্য ওয়াসা, রাজউক, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরের দায় ও জবাবদিহিতা নিরুপনের লক্ষ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী করেন।
অন্যান্য বক্তারা বলেন, এক সময় ঢাকা মহানগরীর সকল নিচু এলাকা খাল-বিল, নদী-নালা জালের মতো আন্তঃসংযোগ ছিল। তখন কোন জলাবদ্ধতা ছিল না। প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম বিবেচনা না করেই পুকুর, খাল, নদী ও জলাধার ভরাট করে গড়ে উঠছে রাস্তা-ঘাট, শিল্প-কারখানা, সুরম্য অট্টালিকা ইত্যাদি। ফলে প্রাকৃতিক ভাবে স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে। লক্ষ কোটি টাকা দিয়েও সেই সুন্দর প্রাকৃতিক নিস্কাশন ব্যবস্থার বিকল্প তৈরি সম্ভব নয়। তাছাড়া খাল-বিল সমূহ পানি নিষ্কাশন ছাড়াও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে আমাদের জীবন মান বজায় রাখার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, খেসারত হিসেবে আমাদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। জলাবদ্ধতার কারণ ও তা নিরসনে সামগ্রিক দিক বিবেচনা না করে বরং একে পুঁজি করে ব্যয়বহুল অনেক প্রকল্প গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষ ব্যয়বহুল প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ হলেও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজের প্রতি তারা চরম উদাসিনতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাজের সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
জলাবদ্ধতা কমাতে/ নিরসনে সুপারিশ সমূহ:
(১) ওয়াসা, রাজউক এবং সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ ব্যয়বহুল প্রকল্পের আসক্তি এবং দায়িত্বহীন আচরণ থেকে বিরত থেকে তাদের সামগ্রিক কাজের দায়ভার বহন করা।
(২) অবিলম্বে “কনসালটেন্ট ও সিভিল সোসাইটির সদস্য” ছাড়াও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহের সাথে ধারাবাহিকভাবে অর্থবহ আলোচনা ও পর্যালোচনার কাঠামো তৈরি করা। এই কাঠামোর তত্ত্বাবধানে সামগ্রিক বিষয়সমূহ বিবেচনা করে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা এবং তা বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করে সময় ভিত্তিক একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা।
(৩) সর্বনিম্ন খরচে এবং অবকাঠামোর পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে ভূগর্ভস্থ বিভিন্ন অবকাঠামোর একটি ত্রিমাত্রিক জরিপ করা। জরিপের পর ত্রিমাত্রিক একটি অবকাঠামো মহাপরিকল্পনা করে সঠিক ঢালু ও মাপের ড্রেনেজ অবকাঠামো তৈরি করা।
(৪) প্রাকৃতিক জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে খালসমূহ উদ্ধার ও খনন করে নদীর সাথে সংযোগ সৃষ্টি করা।
(৫) বক্সকালভার্ট সমূহকে ভেঙে খালে পরিণত করা।
(৬) ঢাকার স্ট্রাকচারাল মহাপরিকল্পনার আওতায় চিহ্নিত জলাধার সমূহকে উদ্ধার ও খনন করা।
(৭) নিচু এলাকা, পুকুরসমূহকে সংরক্ষণ করা।
(৮) অবকাঠামো উন্নয়নের নামে বড়বড় গাছসমূহকে নিধন না করা এবং বড় গাছের সংখ্যা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়া।
(৯) গৃহস্থালি-বর্জ্যসহ কনস্ট্রাকশন দ্রব্যাদি ও বর্জ্য যাতে ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে তার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
(১০) ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অবকাঠামো এবং রাস্থার কাজের মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
(১১) অবকাঠামো তৈরি কাজে সমন্বয় সাধন করা।