শীতে বয়স্ক, শিশু ও হাঁপানি রোগীরা বেশি শ্বাসকষ্টে ভুগে কেন?
মোস্তফা কামাল পলাশ
শীতকালে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে বয়স্ক, শিশু ও হাঁপানি রোগে আক্রান্ত মানুষরা বেশি শ্বাসকষ্টে ভুগে কেন?
বায়ুদূষণ পরিমাপের জন্য যে সূচক ব্যবহার করা হয় তা হলো, প্রতি ঘনমিটারে পার্টিকুলেট ম্যাটারের পরিমাণ। এক ঘনমিটারের মধ্যে কত মাইক্রোগ্রাম পার্টিকুলেট ম্যাটার আছে তার উপর ভিত্তি করে বায়ু দূষণ নির্দেশ করা হয়। পার্টিকুলেট ম্যাটার হলো— বাতাসের মধ্যে ধূলিকণা, ময়লা, আবর্জনা, লতাপাতার ভগ্নাংশ, ফুলের রেণু ইত্যাদি। আকার অনুসারে পার্টিকুলেট ম্যাটারকে দুভাগে ভাগ করা হয়— ব্যাসার্ধ ২.৫ মাইক্রোমিটার (পিএম ২.৫) বা তার চেয়ে কম ও ১০ মাইক্রোমিটারের চেয়ে কম। ১ মাইক্রোমিটার হলো ১ মিটারের ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ বা ১ মিলিমিটারের ১ হাজার ভাগের এক ভাগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গ্রহণযোগ্য ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসার্ধের পার্টিকুলেট ম্যাটারের পরিমাণ এক ঘনমিটারের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ মাইক্রোগ্রাম ও ১০ মাইক্রোমিটার ব্যাসার্ধের পার্টিকুলেট ম্যাটারের পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারের সর্বোচ্চ ২০ মাইক্রোগ্রাম থাকতে হবে। পিএম ২.৫ এতটাই ক্ষুদ্র যে তা চোখে দেখা যায় না।
প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র দূষিত পদার্থ বাতাসে ভাসতে থাকে। বাংলাদেশে যেহেতু শীতকালে কোনো বৃষ্টিপাত হয় না, তাই অক্টোবর থেকে পিএম ২.৫ ও পিএম ১০-এর পরিমাণ বাড়তে থাকে। এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে মে মাসের শেষ সময় পর্যন্ত।
ঢাকায় অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাস তাদের অফিস কম্পাউন্ডে একটি যন্ত্র বসিয়েছে যা ঢাকা শহরের বাতাসের গুণগত মান পরিমাপ করে থাকে (Dhaka US Consulate Air Pollution: Real-time Air Quality Index (AQI))। ঐ যন্ত্রের পরিমাণ অনুসারে ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৮ ঢাকা শহরে পিএম ২.৫-এর ঘনত্ব ছিলো ৩০২ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি।
বাতাসে পিএম ২.৫-এর ঘনত্ব ৩০০ এর বেশি মাইক্রোগ্রাম থাকলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা হলো এই মাত্রা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর বলে চিহ্নিত করেছেন (Health alert: everyone may experience more serious health effects; Everyone should avoid all outdoor exertion)। নিশ্চিত করেই বলা যায়, ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসটি সবচেয়ে কম দূষণ পূর্ণ এলাকায় অবস্থিত। বায়ুদূষণ মাপক যন্ত্রটি আমেরিকান দূতাবাস থেকে নিয়ে শাহবাগ কিংবা ফার্মগেটে বসালে পিএম ২.৫-এর ঘনত্বের মান অনেক বেড়ে যাবে নিশ্চিত করেই বলা যায়।
বাতাসে ভাসমান আকারে বড় দুষিত পদার্থ নিজের ভরের কারণে ভূমিতে পতিত হয় ১-৭ দিনের মধ্যে। অত্যন্ত ক্ষুদ্র দুষিত পদার্থ বৃষ্টির পানিতে দ্রবীভূত হয়ে ভূমিতে পতিত হয়। যেহেতু বাংলাদেশে শীতকালে প্রায় বৃষ্টি হয় না বললেই চলে তাই ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র দূষিত পদার্থ দীর্ঘ সময় ধরে বাতাসে ভাসতে থাকে। ফলে আ্যাজমা রোগে আক্রান্ত বয়স্ক ও শিশু বা শ্বাসকষ্টে ভোগা মানুষ শীত কালে বেশি পরিমাণ দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে ঐ দূষিত বায়ু নিঃশ্বাসের সাথে ফুস্ফুসে প্রবেশ করে। বাতাসে ভাসমান ঐ সকল ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র দুষিত পদার্থের মধ্যে রাসায়নিক কম্পাউন্ড থাকে যা মানুষের নিঃশ্বাসের সঙ্গে সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসে অবস্থিত তরল পদার্থে দ্রবীভূত হয়ে সেই পদার্থের সাথে বিক্রিয়া করে নতুন রাসায়নিক যৌগ তৈরি করে যা অনেক সময় মানুষের ফুসফুসে প্রদাহ বা খুসখুসানি সৃষ্টি করে। যে কারণে আ্যাজমা রোগে আক্রান্ত বয়স্ক ও শিশু (যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে) বা শ্বাসকষ্ট রোগে ভোগা মানুষরা শীতকালে অনেক কষ্টে ভুগে থাকেন।
বায়ুদূষণ সারা বিশ্বে হৃদরোগ ও হাঁপানি বা আ্যাাজমা রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে প্রমাণিত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্যভাণ্ডার Global Burden of Disease (GBD) যে ১০টি রোগে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে, তার পরিসংখ্যান তুলনা করেছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার ১৪টি দেশের সঙ্গে। ওই পরিসংখ্যানমতে, ১৪টি দেশের মধ্যে হৃদরোগ ও ফুসফুসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। অধিকন্তু, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চমাত্রার পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ব্রংকাইটিস, উচ্চ-রক্তচাপ, হাইপার টেনশন, ফুসফুস ক্যান্সার, ডায়াবেটিস রোগের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত বা ওইসব রোগ বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশে চলমান ও প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো স্থাপিত হলে বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটারের পরিমাণ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সেসঙ্গে বাড়বে শীতকালে কুয়াশাযুক্ত দিনের সংখ্যা। ফলে নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পাবে পরিবহন দুর্ঘটনার সংখ্যা। কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে শীতকালে ভয়ংকর বায়ু দূষণের উত্তম উদাহরণ ভারত ও চিন। এই দুইটি দেশের রাজধানী সারা বিশ্বে বায়ু দূষণের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে অবস্থিত।
প্রাকৃতিক কারণে যেহেতু বাংলাদেশে শীত কালে বৃষ্টি হয় না সেই সাথে অর্থ-সামাজিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কারণে বায়ু দূষণ কমিয়ে আনার আপাত কোন সম্ভাবনা নাই তাই গ্রাম বাংলায় প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচন “চাঁচা আপনার প্রাণ বাঁচা” মনে চলাই সুস্থ থাকার একমাত্র উপায়। নিজেদের পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তি, শিশু ও আ্যাজমা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বায়ু দূষণ এলাকা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিন বা চলার ব্যবস্থা করুন, ভালো থাকুন।
লেখকঃ পরিবেশ ও জলবায়ু গবেষক
ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।