বিস্ময়ের সুনীল সমুদ্র সৈকত ; পর্বঃ ১
মনিজা মনজুর
সমুদ্র – নীল জলরাশির চাদরে মোড়া বিস্ময়কর এক জগৎ। স্বচ্ছ বালুর তীর,সমুদ্রের গর্জন, মৃদুমন্দ হাওয়া, ঝিনুক-শামুক-কাঁকড়ার লুকোচুরি, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত সব মিলিয়ে মনের ক্যানভাসে উঠে আসে সমুদ্র সৈকতের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এর সাথে যদি আরো কিছু যোগ হয়! একটু অন্যরকম! কেমন হবে তাহলে? খুব একটা মন্দ হয় না!
পৃথিবীর ১৫ টি অদ্ভূত এবং বিস্ময়কর সমুদ্র সৈকত নিয়ে এবার রয়েছে এনভাইরনমেন্টমুভ.কম এর ধারাবাহিক ফিচার। আজকের পর্বে থাকছে কাঁচ, শামুক এবং গুহাকৃতির পাঁচটি অদ্ভূত সমুদ্র সৈকতের গল্প।
১। গ্লাস বীচ, ক্যালিফোর্নিয়া
আস্তাকুঁড়ের আবর্জনা থেকে সমুদ্র সৈকত!! ভাবা যায়!! বছরের পর বছর ফেলে দেওয়া অব্যবহৃত অকেজো কাঁচ জমা হতে হতে রীতিমত একটা রঙ্গিন শৈল্পিক সমুদ্র সৈকতে পরিণত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার ফোর্ট ব্র্যাগ এর উপকূলের অধিবাসীরা তাদের গৃহস্থালীর আবর্জনা ফেলত ‘Union Lumber Company” এর মালিকানাধীন একটি বাঁধের উপর। ১৯৬৭ সালে ‘California State Water Resources Control Board’ এলাকাটি বন্ধ করে দেয়। আবর্জনার এই ভাগাড় ধ্বংস করতে যথাযথ ব্যবস্থাও নেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এতো এতো আবর্জনা যে অবশিষ্টাংশ হিসেবে পড়ে থাকে নানান রঙ্গের কাঁচের টুকরো এবং মৃতশিল্পের ভাঙ্গা অংশবিশেষ। নুড়ি পাথর আর রঙ বেরঙের কাঁচের সমারোহে অদ্ভূত সুন্দর বুননের সৃষ্টি হয়। উপায় না দেখে বেশ কয়েকবার মালিকানার হাতবদল হয়ে ২০০২ সালের অক্টোবরে একে MacKerricher State Park এর সাথে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পর্যটকদের জন্য এই সমুদ্র সৈকতটি নিঃসন্দেহে চমৎকার একটা জায়গা। প্রতি বছর এখানে আয়োজন করা হয় কাঁচ উৎসবের। ‘Menzies’ wallflower’ নামে একধরনের উদ্ভিদ জন্মায় এই সৈকতে, যদিও এটি বিলুপ্তপ্রায়। গ্রীষ্মের দিনগুলোতে অনেকেই আসেন কাঁচ কুড়াতে। কিন্তু এই কাঁচের সমুদ্র সৈকতে কাঁচ কুড়ানো নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ হবেই বা না কেন! সব কাঁচ নিয়ে গেলে এটি কি তার শৈল্পিকতা ধরে রাখতে পারবে!
২। হিডেন বীচ ইন মারিয়াটা, মেক্সিকো
নাম শুনলেই একটু খটকা লাগে! সমুদ্র সৈকত আবার গোপন থাকে কিভাবে! ১৯০০ সালে মেক্সিকান সরকারের একটি সামরিক পরীক্ষার প্রাক্কালে এই অসাধারন জায়গাটির সৃষ্টি। এটি একটি দ্বীপ দ্বারা বেষ্টিত, যার নাম মারিয়েটা আইল্যান্ড। স্থানীয় ভাষায় এই সমুদ্র সৈকতটিকে বলা হয় “Playa de Amor” বা ‘বীচ অফ লাভ’। দৈত্যাকৃতির গহ্বর এর খোলস, স্বচ্ছ নীলাভ-সবুজ পানি আর কোমল সাদা বালুচরে পৌঁছতে হলে আপনাকে একটি ৫০ ফুট টানেলের ভিতর দিয়ে সাঁতার কেটে যেতে হবে!! ভালোই ঝামেলা বটে!! কিন্তু ক্লান্ত হলে কি হবে সমুদ্র তটে গিয়েই দেখা পাচ্ছেন ‘Humpback whales’ নামের তিমিমাছ আর বিচিত্র সব উদ্ভিদরাজির। UNESCO এর স্বীকৃতি প্রাপ্ত এই সমুদ্রতট পরিচালিত হয় মেক্সিকান সরকারের তত্ত্বাবধানে।
৩। দ্যা বীচ অফ ক্যাথেড্রাল, স্পেন
নাম শুনেই বুঝতে পারছেন এর সাথে গির্জার একটা সম্পর্ক আছে। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় ‘Praia de Augus Santan’ যার অর্থ পবিত্র জলের তীর। মূলত, তীরে আছড়ে পড়া পানির আঘাতে পাথরের দেয়ালে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে দেয়ালগুলো গির্জার খিলান আকৃতির রূপ নেয়। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই তোরণ আর ছোট গুহার দেখা পাবেন ভাটার সময়। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সময় হলো জোয়ারের সময়টা। কারণ তখন আপনি খাড়া পর্বতের উপর দাঁড়িয়ে নীল জলরাশির উত্তাল রূপ দেখতে পাবেন। খাড়া এইসব পর্বত বা পাথরের দেয়ালসমূহ এক প্রকার রূপান্তরিত শিলা,যেমন- স্লেট পাথর (Slate) এবং সিস্ট (Schist) দিয়ে গঠিত। এক একটা দেয়াল প্রায় ৩০ মিটার লম্বা। তবে ঘুরতে গিয়ে একটা ব্যাপার লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন- পানি খুব দ্রুতই তীরটিকে ঘিরে ফেলে। তাই সমগ্র তীরটিকে ঘিরে ফেলার আগেই কেটে পড়তে হবে আপনাকে। কারণ, এই তীরের গঠন অনেকটা অনুভূমিকভাবে প্রসারিত।
৪। শেল বীচ, শার্ক বে, অস্ট্রেলিয়া
জ্বী, ঠিকই ধরেছেন- ঝিনুক-শামুকের ব্যাপার। । পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ডেনহামের ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে শার্ক বে অঞ্চলে এই সমুদ্রতীরটি অবস্থিত। এলাকাটির ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য এবং স্থানীয় জলবায়ুর কারণে সমুদের পানি অনেক বেশি লবণাক্ত। আর এই অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি শামুক-ঝিনুকের অবারিত বংশবিস্তারে সাহায্য করে। প্রায় ১২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত তুষার শুভ্র এই সমুদ্র সৈকতটি গড়ে উঠেছে ১০ মিটার গভীর লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্রাকৃতির শামুক- ঝিনুকের খোলসে!!
৫। কেভ বীচ ইন আলগ্রিভ, পর্তুগাল
কেভ (Cave) অর্থাৎ এটি অনেকটা গুহাকৃতির সমুদ্রসৈকত। স্থানীয় ভাষায় ‘বেনাগলি বীচ (Benagli Beach) বলা হয়ে থাকে। বিংশ শতাব্দীর আগে এটি ছিল পর্তুগালের একটি গ্রাম। সামুদ্রিক মাছ ধরা ছিল সেই গ্রামের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। পরবর্তীতে এলাকাটিকে পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর করা হয়।