বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস ২০১৫; প্রয়োজন অধিক সমন্বয়!
মো. সাইফুল ইসলাম
ভেটেরিনারিয়ানস তথা প্রাণি চিকিৎসকরা হচ্ছেন স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত একটি বিশেষ পেশাদার ও বৈজ্ঞানিক দল। কারণ তারা বিশ্বের সকল ধরনের প্রাণির (মানুষ ও মাছ ব্যতীত) রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা করে থাকে। আবার আমরা জানি মানুষকে আক্রান্ত করে এরকম শতকরা ৭০ ভাগেরও অধিক রোগ প্রাণি থেকে ছড়ায়। তাই প্রাণিকে রোগমুক্ত রাখার মাধ্যমে ভেটেরিনারিয়ানরা মানুষকে সুখি ও স্বাস্থ্যবান রাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাছাড়া ভেটেরিনারিয়ানরা পরোক্ষভাবে মানুষের নিত্যদিনের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছে।
তাঁরা ওয়ান হেলথ এর আওতায় জনস্বাস্থ্য ও প্রাণি অধিকার, মানুষ এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে। ভেটেরিনারিয়ানরা প্রাণি থেকে প্রাণি কিংবা প্রাণি থেকে মানুষে ছড়ায় এমন জুনোটিক রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়েও গবেষণা করছে। এধরনের রোগগুলো হল জলাতংক, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, ইবোলা ইত্যাদি। এসব রোগ সাধারণত মাংস, ডিম, দুধ, লালারস, দেহ নিঃসৃত তরল ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়াতে পারে।
আবার কিছু রোগ আছে যারা বাহকের সহায়তায় ছড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রতি বছর ১ বিলিয়নেরও অধিক লোক বাহক বাহিত রোগে আক্রান্ত হয়, যার মাঝে প্রায় ১ মিলিয়ন লোক মারা যায়। সাধারণত বাহক শতকরা ১৭ ভাগেরও অধিক সংক্রামক রোগের জন্য দায়ী। আমাদের অতি পরিচিত কয়েকটি বাহক হল মশা, মাছি, আঁটুলি (Tick) ইত্যাদি। বাহকের সহায়তা নিয়ে ছড়ানো রোগ গুলোর মধ্যে পরিচিত কয়েকটি হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বর, ম্যালারিয়া জ্বর, কালাজ্বর, প্লেগ, স্লিপিং সিকনেস, ইত্যাদি। তাই মানুষের বাহক বাহিত রোগ প্রতিরোধে বাহকগুলোকে প্রতিরোধ করা জরুরী। বাহকের জীবনচক্র জানা থাকলে খুব সহজেই এদের নির্মূল করা যায়। তাছাড়া কোন একটি রোগ ছড়ানোর জন্য যে বাহক দায়ী, সে বাহক সেই স্থানে আছে কিনা তা জেনেও রোগ সনাক্ত করা যায়। যেমন স্লিপিং সিকনেস রোগটি আমাদের দেশে হয়না কারণ এখানে সিসি ফ্লাই (Tsetse fly) নেই। একজন ভেটেরিনারিয়ান এসব বিষয় নিয়ে প্রচুর জ্ঞান রাখে। এসব বাহকের উপদ্রপ হ্রাসের মাধ্যমে একজন ভেটেরিনারিয়ান প্রাণি ও মানুষের রোগ নির্মূলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
ভেটেরিনারিয়ানরা বিভিন্ন রোগের টিকা আবিষ্কারে নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত টিকাগুলো প্রাণির উপর পরীক্ষালদ্ধ ফলাফল। তাছাড়া Salmonella sp. Brucella sp., Oncoviruses, Botulism সহ নানাবিধ রোগের জীবাণু প্রথম সনাক্ত করেছিল ভেটেরিনারিয়ানরা।
সহজভাবে বলতে গেলে সারাবিশ্বের প্রাণি স্বাস্থ্য ও মানব স্বাস্থ্যসেবায় অবদান রাখায় ভেটেরিনারিয়ানদের গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁদের অবদানে প্রাণিসম্পদে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। তাই মানব কল্যাণে ভেটেরিনারি শিক্ষা ও গবেষণার অবদানকে সামনে রেখে ভেটেরিনারিয়ানদের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডকে আরো বেগবান করতে বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন (WVA) ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার ভেটেরিনারি দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় এবছর ১৫ তম ‘বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস’ পালিত হচ্ছে আজ। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে “Vector-borne disease with zoonotic potential” অর্থাৎ “প্রাণি থেকে মানুষে সংক্রমনযোগ্য বাহক বাহিত রোগের গুরুত্ব”। সমাজ সেবায় ভেটেরিনারিয়ানদের অবদানের জন্য ২০০৮ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন (WVA) ও ওয়ার্ল্ড অরগানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথ (OIE) যৌথভাবে বিশেষ পুরষ্কারের ব্যবস্থা করেছে।
বিশ্বের ৮০ টি দেশ এই দিবস একযোগে উদযাপন করছে। আমাদের দেশেও ভেটেরিনারি শিক্ষার ও পেশার সাথে জড়িত ব্যাক্তিবর্গ মহাসমারোহে দিবসটি উদযাপন করছে। দেশের চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাভিয়ান ভেটেরিনারিয়ান ইন বাংলাদেশ (AAVBC) ও রাজধানীতে ভেট এক্সিকিউটিভ সকালে র্যালী, আলোচনা সভা, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, ভ্যাক্সিনেশন প্রোগ্রাম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির আয়োজন করেছে।
মানব চিকিৎসায় ও রোগ প্রতিরোধে মেডিক্যাল ডাক্তারদের সাথে সমণ্বয়ভাবে কাজ করতে হবে ভেটেরিনারিয়ানদের। উন্নত বিশ্বে এমন সমণ্বয় থাকলেও আমাদের দেশে এখনো তেমন সমণ্বয়তা গড়ে ওঠেনি। তবে ধীরে ধীরে এই অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
লেখক: ইন্টার্ণশীপ শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)।