বিশ্ব জলাভূমি দিবস; বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও চলমান পরিস্থিতি
মিথিলা চক্রবর্তী
২রা ফেব্রুয়ারি “ World Wetland Day” অর্থাৎ বিশ্ব জলাভূমি দিবস। কতটুকু সচেতন আমরা এই দিনটি নিয়ে? সভা-সেমিনার করেই দায়িত্ব শেষ করে বসে থাকি হয়তো, কিন্তু সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জলাভূমি কে ঠিক কিভাবে মূল্যায়ণ করি?
‘WETLAND’ বা জলাভূমি আমাদের অনেক পরিচিত একটি শব্দ। কিন্তু আসলেই তা বলতে কী বুঝায় আমরা অনেক কম মানুষই বুঝি। এমনকি হয়ত কখনই খুঁজে দেখিনি জলাভূমি ঠিক কাকে বলে! দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া.. কিছুটা এরকমই যেন আমাদের অবস্থা। বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ ভূমি জলাভূমির অন্তর্গত। এবার আসি কোন ধরনের ভূমি এই শ্রেণিতে পড়ে! সোজা কথায়, যে সমস্ত ভূমি বছরের ৯ মাস পানির নিচে থাকে তাদের কে জলাভূমি বলা হয় । যেমন আমাদের দেশের উত্তরপূর্বের হাওর-বাওর , বিল এবং উত্তর-পশ্চিমের কিছু বিল। উদাহরণ হিসেবে, রামসাগর , টাঙ্গুয়ার হাওর , চলন বিল, মেদা বিল হাকালুকি হাওর ইত্যাদি নাম তো সবারই চেনা। শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, যখনই এরকম ভূমির কথা আসে, তখন সাথে সাথেই উঠে আসে একটি সভা বা সম্মেলন এর কথা; যার নাম “রামসার কনভেনশন”। এটি একটি আন্তঃসরকার চুক্তি যা সর্বপ্রথম জলাভূমি সুরক্ষা নিয়ে কথা তোলে। এই সম্মেলন হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রামসার নামক ইরানের একটি শহরে। সেই সময় যেসব রাষ্ট্র ঐ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে, তাদের প্রত্যকেই নিজ নিজ দেশের জলাভূমি সংরক্ষণে সচেষ্ট হতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ ভূ-প্রাকৃতিক কারণে স্বাভাবিকভাবেই অনেক জলাভূমির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে একটু দেরীতে। যেহেতু ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম জলাভূমি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশের উদাহরণ স্বরূপ একটি সেমিনারের আয়োজন করে, তাই সেই সালে বাংলাদেশ প্রথম এই সম্মেলনের সাথে যুক্ত হয়। এবং এর পরপরই ২০০০ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশের টাঙ্গুয়ার হাওর কে দ্বিতীয় রামসার কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এক হিসেবে বলা হয়ে থাকে এই পুরো বিশ্বে মোট যে ভুমি রয়েছে তার থেকে প্রায় ৬% বেশি হচ্ছে জলাভূমি যা পরিমানে প্রায় ৮৬ লক্ষ কিলোমিটার। এই উপমহাদেশের তিনটি বড় নদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণ সহ প্লেট টেকটনিক এর কারণে বেশ কিছু জলাভূমি বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রামসার সম্মেলন (২০০০) অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই ধরণের ভূমিকে ভাগ করা যায় মোট ৭ ভাগ। যথা; মোহনা, উন্মুক্ত উপকূল, বন্যা প্লাবিত, হাওর , বিল, লবনাক্ত জলাভূমি, হ্রদ, এবং জলাচ্ছন্ন বন। যার মধ্যে হাওর এবং বিল সুপরিচিত।
বাংলাদেশের যে পরিমাণ জলাভূমি রয়েছে তার এখনো কোন সঠিক হিসেব যদিও পাওয়া যায় নি, তবে প্রায় ৭৫,১১০০০-৭৮,০০০০০ হেক্টর । রামসাগর, মেদা বিল, টাঙ্গুয়ার হাওর, আইলা বিল, দেখার হাওর, কুরি বিল, ইরালি বিল, দাব্রাইর হাওর, হাকালুকি হাওর, কাওয়াদিঘি হাওর, বিল ভাটিয়া, চলন বিল, আটাডাঙ্গা হাওর, কাপ্তাই লেক, বগাকিন লেক, সুন্দরবন পূর্ব , সুন্দরবন পশ্চিম , সুন্দরবন দক্ষিণ , নাফ মোহনা, সেন্ট মারটিন উল্লেখযোগ্য। শুধুমাত্র এই হাওর এলাকাতেই ৪৭টি বড় হাওর রয়েছে যার মধ্যে ৬৩০০ টি বিল। সিলেট বিভাগের অন্তর্গত এক সুনামগঞ্জ জেলাতেই রয়েছে অনেক হাওর-বাওর আর বিল।
হাওর হলো সাগরসদৃশ পানির বিস্তৃত প্রান্তর। প্রচলিত অর্থে হাওর হলো বন্যা প্রতিরোধের জন্য নদীতীরে নির্মিত মাটির বাঁধের মধ্যে প্রায় গোলাকৃতি নিচুভূমি বা জলাভূমি। তবে হাওর সব সময় নদী তীরবর্তী নির্মিত বাঁধের মধ্যে নাও থাকতে পারে। হাওরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতি বছরই মৌসুমী বর্ষায় বা স্বাভাবিক বন্যায় হাওর প্লাবিত হয়, বছরের কয়েক মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে এবং বর্ষা শেষে হাওরের গভীরে পানিতে নিমজ্জিত কিছু স্থায়ী বিল জেগে উঠে। গ্রীষ্মকালে হাওরকে সাধারণত বিশাল মাঠের মতো মনে হয়, তবে মাঝে মাঝে বিলে পানি থাকে এবং তাতে মাছও আটকে থাকে। শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে, কমে গেলে এখানকার প্রায় ২৪টি বিলের পাড় (স্থানীয় ভাষায় কান্দা) জেগে উঠলে শুধু কান্দা’র ভিতরের অংশেই আদি বিল থাকে, আর শুকিয়ে যাওয়া অংশে স্থানীয় কৃষকেরা রবি শস্য ও বোরো ধানের আবাদ করেন। এসময় এলাকাটি গো-চারণভূমি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বর্ষায় থৈ থৈ পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু কান্দাগুলোতে আশ্রয় নেয় পরিযায়ী পাখিরা —রোদ পোহায়, জিরিয়ে নেয়। কান্দাগুলো এখন (২০১২) আর দেখা যায় না বলে স্থানীয় এনজিও ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় সেখানে পুঁতে দেয়া হয়েছে বাঁশ বা কাঠের ছোট ছোট বিশ্রাম-দণ্ড।
এখন প্রশ্ন হল যে কেন এই ধরনের জমি বা ভূমি নিয়ে এত আলোচনা? বলা হয়ে থাকে “ মাছ –পাথর-ধান সুনামগঞ্জের প্রাণ ’’। ধানের প্রাচুর্য , মাছের চাষ , উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ,ভূতল এবং ভূপৃষ্ঠের পানির উৎস, এছাড়াও পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারন্য হিসেবে এই হাওর বা এ ধরণের জলাভূমির ভূমিকা অসীম। বাংলাদেশের যে মাছ চাষ করা হয়ে থাকে তার প্রায় ৩.২৮% হয় হাওরের মাধ্যমে। বিভিন্ন সূত্র মতে প্রায় ৭২ জাতের ধান চাষ করা হয় এই এলাকাগুলোতে। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এ হাওরের বিখ্যাত মাছের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় মহাশোলের কথা। মাছটির দুটো প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে Tortor এবং Torputitora, টাঙ্গুয়ার হাওরে দুই প্রজাতিই একসময় পাওয়া যেত।
হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। স্থানীয় বাংলাদেশি জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখিরও আবাস এই হাওর। এ হাওরে প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে।পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরে । স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, সারস , ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খচিল। এছাড়া আছে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়ুল (বাংলাদেশে এর নমুনাসংখ্যা ১০০টির মতো)। ২০১১’র পাখি শুমারীতে এই হাওরে চটাইন্নার বিল ও তার খাল, রোয়া বিল, লেচুয়ামারা বিল, রুপাবই বিল, হাতির গাতা বিল, বেরবেরিয়া বিল, বাইল্লার ডুবি, তেকুন্না ও আন্না বিলে প্রায় ৪৭ প্রজাতির জলচর পাখি বা ওয়াটারফাউলের মোট ২৮,৮৭৬টি পাখি গণনা করা হয়। এই শুমারিতে অন্যান্য পাখির পাশাপাশি নজরে আসে কুট, মরিচা ভুতিহাঁস, পিয়ংহাস; সাধারণ ভুতিহাঁস, পান্তামুখী বা শোভেলার, লালচে মাথা ভুতিহাঁস, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, লেনজা, পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখিও।
এছাড়াও ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪ প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি সহ নানাবিধ প্রাণীর বাস, এই হাওরের জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর।
অধ্যাপক আলী রেজা খান-এর বর্ণনানুযায়ী এই হাওরে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০ প্রজাতির পাখি, ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২’র বেশি প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০-এর বেশি প্রজাতির সরিসৃপ এবং ১০০০-এরও বেশি প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণীর আবাস রয়েছে।
হাওরের উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম হলো জলজ উদ্ভিদ। এছাড়া আছে হিজল, করচ, বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলশী, নলখাগড়া, বল্লুয়া, চাল্লিয়া ইত্যাদি জাতের উদ্ভিদও।
কিন্তু এতো কিছুর পরেও আমরা কয়জন এই জলাভূমি গুলোকে গুরুত্ব দেই? জলাভূমি সম্পর্কিত অনেক আইন বা নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠিত থাকলেও প্রতিনিয়ত এগুলো ভাঙ্গা হচ্ছে। বালু ভরাট, ইজারা দেয়া, অনাকাঙ্খিত দূষণ ইত্যাদির ছোবলে আজ সেই আগের জৌলুস আর নেই এসব জলাভূমি বা হাওরের। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা এবং আমাদের মনযোগের অভাব আজকাল এই জলাভূমি গুলোকে প্রায় নিঃশেষ করে দিয়েছে। যেখানে অন্যান্য দেশ প্রাকৃতিক জলাভূমির পাশাপাশি কৃত্রিম জলাভূমি তৈরি করেও নিজেদের উন্নয়ন করছে সেখানে আমাদের মত প্রাকৃতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে প্রায় অবহেলার সাথেই একে দেখা হচ্ছে। কোটি টাকা আয় হচ্ছে ইজারা দেয়ার মাধ্যমে কিন্তু কখনই আমরা ঐ হাওর বা বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবক্ষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছিনা ।
বিশ্ব জলাভূমি দিবস কে স্বাগত জানিয়ে আসুন প্রতিজ্ঞা করি, শুধু গতানুগতিকভাবে এবং নিয়মে বেঁধেই নয়- নিজেদের এবং ভবিতব্যের তাগিদে জলাভূমি সুরক্ষা হোক আমাদের অঙ্গীকার।
উৎস-
১। হাওর কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় জনদলিল, বারসিক।
২। উইকিপিডিয়া