" বন্যপ্রাণীর ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে " – বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস ২০১৬
লিসান আসিব খান
দেয়ালে টানানো ছবির মানুষটি যে আজ আর পৃথিবীতে নেই, সেই ছবিটির দিকে তাকালেই শুধুমাত্র আমাদের ভিতরে তাঁর জন্য মায়ার সঞ্চার হয়, কিছুক্ষণ পরই সেই মায়া হয়তো থাকে না। তেমনি টিভিতে বা চিড়িয়াখানায় গিয়ে বন্য প্রাণিদের দেখলেই আমাদের মায়া হয়, যেটা কয়েক মুহূর্তের জন্য মাত্র । সারা বিশ্বে আছে নাম না জানা হাজারও পশু-পাখি । প্রকৃতির কাছাকাছি গিয়ে আমাদের ক’জনেরই বা সুযোগ হয় তাদের সান্নিধ্য পাওয়ার! চিত্তবিনোদন আর পশু-পাখি সম্পর্কে জানার জন্য আমরা প্রায়ই ভিড় করি পশু-পাখি প্রদর্শনকেন্দ্রে । তাদের বন্দী দশা দেখে হয়তোবা আমাদের চোখের পানি ঝরে কিন্তু পরক্ষণেই আমরা ভুলে যাই তাদের কথা। কখনও কি ভেবে দেখেছি, তাদের এক পলক দৃষ্টি আমাদের বার বার আকুতি জানাচ্ছে এই পৃথিবীতে তাদের একটু আশ্রয় দিতে, ধ্বংস হবার হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে !
আজ ৩ মার্চ , বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস । ” বন্যপ্রাণীর ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে ” এই স্লোগান নিয়ে প্রতি বছরের মত এবারও সচেতনতার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস ২০১৬ । মূলত এই বছর আলোচনার শীর্ষে আছে এশিয়ান এবং আফ্রিকান হাতিদের ভবিষ্যৎ ।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেন ,
“On this World Wildlife Day, I call on all citizens, businesses and governments to play their part in protecting the world’s wild animals and plants. The actions taken by each of us will determine the fate of the world’s wildlife. The future of wildlife is in our hands!”
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে , কিছু প্রাণি আছে যারা ভবিষ্যতে হয়তোবা আর দেখতে পারবে না পৃথিবীর আলো , আমরা তাদের কে চিরদিনের মত হরিয়ে ফেলবো যদি না এখনই তাদের বিলুপ্তি রোধে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হয় ।
এক নজরে দেখে আসা যাক সেইসব প্রাণিদের …
Sumatran Elephant:
সুমাত্রার হাতিদের মুলত অপেক্ষাকৃত নিচু পাহাড়ি অঞ্চলে দেখা যায় । কিন্তু ঋতু ভেদে উচ্চ পর্বতেও তাদের দেখা মেলে। কাগজশিল্পের জন্য বন উজাড় , তাদের বাসস্থান ক্ষতি নানা কারনে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে গত ২৫ বছরে ৭০ ভাগ হাতি বিলুপ্ত হয়েছে , বাকি আছে শুধুমাত্র ২৪০০ থেকে ২৮০০ টি।
Yangtze Finless Porpoise :
Yangtze নদী এশিয়ার দীর্ঘতম নদী যা Yangtze finless porpoise and Baiji নামের দুই প্রজাতির ডলফিনদের আবাসস্থল ছিল । ইতিহাসের প্রথম মানুষের খামখেয়ালিপনার শিকার Baiji ডলফিন প্রজাতি ২০০৬ সালে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় । The Yangtze finless porpoise ডলফিন বর্তমানে ২০০০ এর কাছাকাছি আছে যা যে কোন সময় বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে যদি না অতিরিক্ত মৎস্য শিকার , পানি দূষণ এবং মাত্রাতিরিক্ত জাহাজ চলাচল রোধে পদক্ষেপ নেওয়া না হয় ।
Mountain Gorilla:
তাদের নাম থেকেই বোঝা যায়, এরা পাহাড়-পর্বতের অধিবাসী! মধ্য আফ্রিকার ৮০০০ থেকে ১৩০০০ ফুট উচ্চ পাহাড়ী জঙ্গলে বসবাস করে এই বনমানুষ যা চোরাশিকার এবং মানব আক্রমণের শিকার হয়ে আজ বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে . জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ তাদের আবাসস্থল দখল করে বসতি গড়ে তুলছে যা আদেরকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে । বর্তমানে এদের সংখ্যা প্রায় ১০০০ এর কাছাকাছি ।
South China Tiger:
১৯৫০ সালের দিকে এরা সংখ্যায় ছিল ৪০০০ । ১৯৭৯ সালে চীনা সরকার এদের হত্যা রোধে আইন করে । ১৯৯০ সালের পর থেকে আর দেখা যায় না বাঘের এই প্রজাতিটিকে। তবে কয়েকটি চিড়িয়াখানায় দেখা মিলতে পারে এদের ।
Western Lowland Gorilla:
পশ্চিম মধ্য আফ্রিকা ঘন বন পাওয়া যায় এই ছোট বনমানুষ।৩০ বছর আগেও এরা জনসংখ্যা অনেক ছিল কিন্তু ইবোলা ভাইরাসের শিকার হয়ে আজ তারা ধ্বংসের পথে । বিগত ২০ থেকে ২৫ বছরে মধ্যে তাদের ৬০ ভাগই বিলুপ্ত হয়েছে । বর্তমানে কিছু সংখ্যক চিড়িয়াখানায় এদের দেখা যায় ।
Hawksbill Turtle:
Hawksbill কচ্ছপ আটলান্টিক, প্যাসিফিক, এবং ভারতীয় মহাসাগরের মধ্য অংশে পাওয়া যায়. বিপন্ন প্রজাতিসত্ত্বেও Hawksbill এর ডিম এখনও বিশ্বের অনেক জায়গায় খাওয়া হয় এবং তাদের মাংস সুস্বাদু হবার কারণে তাদের হত্যা করা হয়। এছাড়াও মাছ ধরার জালে দুর্ঘটনাজনিত কারণে আটকা পরে মারা যাচ্ছে যা তাদের প্রজাতি কে হুমকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
Soala :
এটি ১৯৩০ সালের পর আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণি। দুই দশক আগে ১৯৯২ সালের মে মাসে, বিজ্ঞানীরা ভিয়েতনাম-লাওস সীমান্তের ঘন পর্বতে এই প্রাণিটি দেখতে পান । ২০১২ সালে ২০ তম বার্ষিকী পালন করা হলেও বিজ্ঞানীরা সতর্কবাণী দিয়েছেন যে বর্তমানে এদের সংখ্যা ২০০ এর কাছাকাছি যা আগামি বছরে নাও দেখা যেতে পারে।
Black Rhino:
সারা বিশ্বের মাত্র পাঁচটি সাদা গণ্ডারের মধ্যে সম্প্রতি একটি সাদা গণ্ডার সান-দিয়েগো চিড়িয়াখানায় মারা যায়। কিন্তু কালো গণ্ডারও হুমকির সম্মুখীন । তৃণভূমি এবং পূর্ব আফ্রিকার উপকূলবর্তী মরুভূমিতে মধ্যে কখনও কখনও খাদ্যের জন্য তাদের হত্যা করা হয়। ২০১২ সালে আইইউসিএন দ্বারা প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে সারাবিশ্বে শুধুমাত্র প্রায় ৫০৫৫ টি কালো গণ্ডার আছে।
Asian Rhino :
এশিয়ান গণ্ডারের ৩ টি প্রজাতির মধ্যে ২ টি প্রজাতি – জাভান এবং ভারতীয় গণ্ডার আজ হুমকির সম্মুখীন ।একশৃঙ্গী গণ্ডার অর্থাৎ ভারতীয় গণ্ডার হল সবচেয়ে বৃহত্তম প্রজাতি। ২০ শতকের কিছু আগে ভারতীয় উপমহাদেশে এদের বিচরণ ছিল। কিন্তু ২০ শতকের দিকে এদের ৯০ শতাংশ বিলুপ্ত হয় এবং ১৯৭৫ সালের দিকে মাত্র ৬০০ টি অবশিষ্ট থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে এই প্রজাতিটি অনেকাংশে বিলুপ্ত।
Vaquita :
বিলুপ্তির যুগে Vaquita বিশ্বের সবচেয়ে বিরল সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণি। ক্যালিফোর্নিয়া , মেক্সিকো এর উপসাগরীয় অঞ্চলে এবং সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকায় অবৈধ মাছ ধরার কারণে Vaquita প্রায়ই জালে ধরা পড়ে, তাদের অর্ধেকেরও বেশি গত তিন বছরে মারা যায় । বর্তমানে সারা পৃথিবীতে তাদের সংখ্যা প্রায় ১০০ যা আমাদের জন্য সত্যিই হতাশাজনক।