বিশ্ব রোগ সংক্রামক দিবস; সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন!
মনিজা মনজুর
ওয়ার্ল্ড জুনোসিস ডে (World Zoonosis Day) অর্থাৎ বিশ্ব রোগ সংক্রামক দিবস। রোগ সংক্রমন এর উপর গুরুত্বারোপ এবং এই সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর ৬ জুলাই এই দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়। পৃথিবীতে প্রায় ১৫০ সংক্রামক রোগের অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে গৃহপালিত পশু এবং মানুষের মধ্যে যে সকল সাধারণ রোগ দেখা যায়, বন্যপ্রানীরাই মূলত সেইসব রোগের আধার! যারা বন্যপ্রানী নিয়ে কাজ করেন তাদের রোগ সংক্রমনের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, সাধারণ মানুষেরও প্রয়োজন সচেতনতা।
চলুন জেনে নিই ‘জুনোসিস’ কী? গ্রীক ‘জুন(zoon)’ অর্থ প্রানী(animal)। ‘নোসোস(nosos)’ অর্থ ‘অসুস্থতা(ailment)’। জুনোসিস মূলত একটি প্রক্রিয়া যেখানে রোগবালাই প্রানী থেকে প্রানীতে, প্রানী থেকে মানুষে, মানুষ থেকে মানুষে এমনকি মানুষ থেকে প্রানীতেও সংক্রমিত হয়। রোগ বহনকারী জীবাণুর সম্পূর্ণ জীবনচক্র সম্পন্ন করতে শুধুমাত্র একটি পোষক দেহের প্রয়োজন হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জীবনচক্রের কোনো পর্যায়েই এদের বাহ্যিক পরিবর্তন হয় না।
মানুষকে আক্রমনকারী ১,৪১৫ টি পরজীবীর মধ্যে ৬১% ই জুনোটিক অর্থাৎ সংক্রামক। মানুষ সাধারণত দূর্ঘটনার বশবর্তী হয়ে, আক্রান্ত প্রানীর কামড়, লালা কিংবা রক্তের সংস্পর্শে আসলে এইসব রোগে আক্রান্ত হয়। সম্প্রতি মানুষ এবং বন্যপ্রানীর সংস্পর্শ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে নতুন ধরনের রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে জনহীন স্থানে মানুষের অনুপ্রবেশ এবং বন্য প্রানীদের মনুষ্য এলাকায় প্রবেশও সংক্রামক রোগ বৃদ্ধির কারণ হয়ে থাকে।
আক্রান্ত পোল্ট্রি, তীক্ষ্ণ দাঁতের প্রানী, সরিসৃপ, উভচর, পোকা-মাকড়, গৃহপালিত এবং বন্যপ্রানীর সংস্পর্শে আসলে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়াও বন্যপ্রানী প্রদর্শনী, পশুশালা, পোষাপ্রানীর দোকান, পার্ক, কাঠ এবং ঝোপঝাড় যুক্ত এলাকা, পশুচারণক্ষেত্র থেকেও রোগ সংক্রমনের সম্ভাবনা আছে।
সংক্রমিত রোগের তালিকায় আছেঃ প্লেগ, টিউবারকিউলোসিস, অ্যানথ্র্যাক্স, ক্যাট স্ক্র্যাচ ফিভার, টিক প্যারালাইসিস, হান্টা ভাইরাস, রিং ওয়ার্ম, সালমোনেলোসিস, লেপ্টোস্পাইরোসিস, স্ক্যাবিস, র্যাবিস বা জলাতঙ্ক, ম্যাড কাউ ডিসিস ইত্যাদি। লেপ্টোস্পাইরোসিস এবং ম্যাড কাউ ডিসিস বিশ্বজুড়ে বেশ প্রভাবশালী রোগ হলেও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাটা বেশি। র্যাবিস কন্ট্রোল সোসাইটির হিসাব মতে, জলাতঙ্ক এবং টিউবারকিউলোসিস এ আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ভারতে প্রায় ৩০,০০০ এবং পৃথিবীতে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ মারা যায়। উল্লেখ্য, শিয়াল, ভালুক, বাদুড়, বেজি ইত্যাদি বন্য জীবজন্তুর কামড় বা থাবার মাধ্যমে রোগের ভাইরাস মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হতে পারে।
প্রানীর আক্রমনের শিকার হলে প্রথমেই ক্ষতস্থান সাবান এবং প্রচুর পানি সহকারে ধুয়ে ফেলতে হবে। সম্ভব হলে স্পিরিট বা আয়োডিন লাগাবেন। দ্রুত চিকিৎসকের শরনাপন্ন হবেন। কামড়ের দিনই প্রতিষেধক টিকা নেয়া শুরু করতে হবে। জলাতঙ্কে আক্রান্ত কুকুরের কামড়ে গরু, ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত প্রাণীরও জলাতঙ্ক হতে পারে। এসব প্রাণীর মাংস খেয়ে মানুষও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ঝাড়ফুঁক বা এ জাতীয় পদ্ধতিতে জলাতঙ্ক বা কুকুর কামড়ের কোন চিকিৎসা করা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষতস্থানে চুন, হলুদের গুঁড়া বা এ জাতীয় কিছু লাগিয়ে কোন উপকার হয় না। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। রোগাক্রান্ত মৃত মানুষের অঙ্গ অন্য মানুষে শরীরে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেও রোগ ছড়ায়।
সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে বলা যায়, আপনার পোষা কুকুর, বিড়াল বা অন্য প্রানীকে নিয়মিত বিরতিতে রোগ প্রতিষেধক টিকা দিন। বন্যপ্রাণী এবং যেসব প্রাণী সম্পর্কে বিশেষ জানা নেই সেসব প্রাণী থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন। যাদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে হয় তারা আগে থেকেই টিকা নিয়ে রাখতে পারেন। আমরা অনেক সময়ই আসবধানতা বশতঃ পোষা প্রানীর রোগ বালাইয়ের ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যাই, যা একসময় আপনাকে বা আপনার পরিবারকে ভয়াবহ বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে। তাই এ বিষয়ে নিজে সচেতন হউন, অন্যকে সচেতন করুন এবং রোগ সংক্রমনের হাত থেকে নিরাপদে থাকুন।
দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে ইন্টারন্যাশনাল এনিম্যাল হেলথ অর্গানাইজেশন একটি তথ্যবহুল লিফলেট তৈরি করেছে। সেটি ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন এখানে